নিউজ ডেস্ক:
“পঁচিশ বছর ধরিয়া স্বৈরাচারী পন্থায় ও সামরিক শক্তিতে আমাদেরকে শাসন করিলেন, গরিব বাংলার সম্পদটুকু দু’হাতে লুটিয়া ইমারতের উপর ইমারত গড়িলেন, শেষ পর্যন্ত ইলেকশনে হারিয়া লাঠি ধরিলেন; বন্দুক ও সঙিনে গণহত্যা করিলেন, কামান দাগিয়া আমাদের দালান-ইমারত ধূলিসাৎ করিলেন; ত্রিশ লক্ষ লোককে খুন, তিন কোটি লোককে গৃহত্যাগী ও এক কোটি লোককে দেশত্যাগী করিলেন; বস্তি-বাজার, বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামার, বাগান-বাগিচা, গাছপালা ও ব্যাংকের কারেন্সি নোট পোড়াইলেন; যুদ্ধে হারিয়া আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে আমাদের সুধী সমাজকে বর্বরভাবে কাতলে-আম করিলেন। এত করার পরেও বাংলার নেতার মুখ দিয়া বাঙালি বলিতে পারিয়াছে, ‘পশ্চিমা ভাইরা, আমরা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ চাই না।
তোমরা সুখে থাক, আমাদেরও সুখে থাকিতে দাও।” (আবুল মনসুর আহমদ, শেরেবাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু, পৃ. ১৭)। সে বাংলার নেতা আর কেউ নন, আমাদের ত্রাণকর্তা, আমাদের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যিনি অসাধারণ শুধু সাহসিকতার জন্য নয়, শুধু আপসহীনতার জন্য নয়, সমগ্র জাতির আকাক্সক্ষা ও মুক্তির যে স্বপ্ন, তা তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, একটি জাতির স্বপ্নকে তিনি তার নিজের স্বপ্ন বলে মনে করেছিলেন। পরাধীনতার নিগড় থেকে স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে হাত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিদের উদ্দেশে তার আহ্বান ছিল প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা নয়, শান্তি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে তারা যেন পাশে দাঁড়ান।
কিন্তু হানাদাররা তার সেই উদারতাকে কোনো মূল্য দেয়নি। তাদের এ দেশীয় দোসরদের দিয়ে সপরিবারে বুলেটবিদ্ধ করল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা জানে না ব্যক্তির মৃত্যু হলেও আদর্শের মৃত্যু হয় না। জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আজ সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল।
বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ছোটবেলা কাটে নদীতে সাঁতার কেটে, সমবয়সীদের সঙ্গে হেসে খেলে ও দুষ্টুমি করে। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান চাকরি করতেন মাদারীপুর কোর্টে সেরেস্তাদার পদে। তিনি কিশোর মুজিবকে নিয়ে এলেন মাদারীপুরে। ভর্তি করে দিলেন মাদারীপুর ইসলামিয়া স্কুলে। এখানে লেখাপড়া করতে করতে মুজিব বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এ রোগের চিকিৎসা চলতে চলতে তিনি চোখের গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন।
মাদারীপুর ও ফরিদপুরে চিকিৎসা করে যখন গ্লুকোমা ভালো হল না, তখন পিতা শেখ লুৎফর রহমান তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চোখের চিকিৎসক ডা. টি. আহমেদকে দেখানোর জন্য মুজিবকে কলকাতায় নিয়ে যান। তিনি মুজিবের চোখ অপারেশন করে চশমা পরার পরামর্শ দিলেন। সেই থেকেই তিনি চোখে চশমা পরেন। কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর বাবা তাকে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশবরেণ্য নেতা হয়ে ওঠার প্রথম লক্ষণ দেখা দেয় ১৯৪০ সালে, তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র।
এ সময় স্কুল পরিদর্শন করতে আসেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তার সঙ্গে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী দলবলসহ কাঁচা রাস্তায় পায়ে হেঁটে কাছেই ডাকবাংলোর দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল অদূরে কয়েকজন ছাত্র রাস্তা আটকিয়ে কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য স্লোগান দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের কাছে গিয়ে বললেন, তোমরা কী চাও? উত্তরে চোখে চশমা, হ্যাংলা লম্বা ছাত্রটি বেশ দৃঢ় ও নির্ভীক কণ্ঠে উত্তর দিল- ‘আমাদের স্কুল-হোস্টেলের ছাদ দিয়ে বর্ষাকালে অনবরত পানি পড়ে, এতে আমাদের বই-খাতা, বালিশ, তোষক ও লেপ ভিজে যায়। তাই হোস্টেলের ছাদ মেরামত করার ব্যবস্থা না করলে পথ ছাড়ব না।’
প্রধানমন্ত্রী বললেন, ছাদ মেরামত করতে কত টাকা লাগবে? ছেলেটি নির্ভীক ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ১২০০ টাকা। প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ তার স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১২০০ টাকা মঞ্জুর করে দিলেন এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এসডিও সাহেবকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল-হোস্টেলের ছাদ মেরামত করার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন।
ছেলেটিকে কাছে ডেকে কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমার সৎ সাহস ও নির্ভীক উত্তরে আমি খুব খুশি। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা খাদ্যমন্ত্রী পুরো ঘটনাটি লক্ষ করছিলেন। ঝানু রাজনীতিক ছিলেন বলে বুঝতে পারলেন ছেলেটিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলে সে ভবিষ্যতে একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
ডাকবাংলোয় পৌঁছেই তিনি পিয়নের মাধ্যমে খবর দিয়ে তাকে ডাকবাংলোয় ডেকে আনলেন। দু’জনে অনেক আলাপ-আলোচনা করলেন। বিদায় নেয়ার সময় সোহরাওয়ার্দী নিজের ঠিকানা দিয়ে কলকাতায় দেখা করতে বললেন। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ঠিকানা অনুযায়ী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন। সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে রাজনীতির বিভিন্ন কলাকৌশলের দীক্ষা দেন। সেই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক।
ছাত্র রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আমল থেকেই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রচণ্ড প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল।
তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বুঝতে পেরেছিলেন, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালিরা নতুন করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তার আজ্ঞাবহদের দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত হতে থাকবে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন উৎসবে ঘোষণা দেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। শেখ মুজিবসহ আরও দু’জন ছাত্রনেতা তাৎক্ষণিকভাবে ‘না না না’ ধ্বনি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানান।
এ থেকে শুরু হয় প্রতিবাদী চেতনার স্ফুরণ। তমদ্দুন মজলিস নামক সংগঠনটি ঢাকায় গঠিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ওই সংগঠনসহ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠন করেন ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পালিত হয় ‘ভাষা দিবস’। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক নৌযাত্রায় বিখ্যাত গায়ক আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১১১)।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংগঠিত করার আন্দোলনে আইনের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের, বিশেষ করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমেনি। প্রদেশব্যাপী চলছিল পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার ও নির্যাতন। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চেতনাকে মুছে ফেলতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধু মানুষের আবেগ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত ছিলেন।
মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে ঢাকার রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় প্রথম নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। এতে মওলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিব যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তীকালে স্বৈরাচারী মুসলিম লীগের গণবিরোধী রাজনীতি মানুষকে ব্যথিত করে তোলে।
মুসলিম লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিত করার ব্যাপারে দলীয়ভাবে তৎপর হন তিনি। গঠন করেন নির্বাচনী মোর্চা যুক্তফ্রন্ট। সম্মিলিত বিরোধী দলের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ রাজনীতির ভরাডুবি ঘটে। কিন্তু কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার আদমজীতে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গার অজুহাতে ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটায়। শেখ মুজিব মন্ত্রী থাকাকালে দলের স্বার্থে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ২১ দফা কর্মসূচি ছিল পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসার মূলমন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর জবানীতে ‘কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল জানেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনমত সৃষ্টি করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে- চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মিলিটারিতে বাঙালিদের স্থান দেওয়া হচ্ছে না- এ সম্বন্ধে আওয়ামী লীগ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে কতগুলি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছে সমস্ত দেশে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২৫৮)।
শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষের ভোটে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের সঙ্গে বেইমানি করে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতিতে পালাবদল ঘটে। সামরিক শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান। শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহু রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় থেকে বাঙালির স্বাধিকারের বীজ বপন করতে থাকেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬১ সালের শুরুতে আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
শেখ মুজিব সেদিন স্বাধীনতার দাবিকে আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখার জন্য অনুরোধ করেন কমরেড মনি সিংকে। কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক খোকা রায় তার ‘সংগ্রামের তিন দশক’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব তুললেন এক মৌলিক প্রশ্ন। তিনি বললেন, এসব দাবি-দাওয়া কর্মসূচিতে রাখুন, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু একটা কথা আমি খোলাখুলি বলতে চাই, আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন এসব কোনো দাবিই পাঞ্জাবিরা মানবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালিদের মুক্তি নেই। স্বাধীনতার দাবিটা আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখা দরকার।’ (মুহাম্মদ শামসুল হক, স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রস্তুতি, পৃ: ১৪)।
’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, ’৬৫-এর মৌলিক গণতন্ত্রী পন্থায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে সক্রিয় থাকেন। এ সময় পূর্ব বাংলায় সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর কোনো সদর দফতর ছিল না। এ ছাড়া পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক বৈষম্য ছিল পাহাড় সমান। এ বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে তিনি জাতির সামনে বাঙালির ন্যায্যতা ও শাসন সংবলিত ৬ দফা দাবি পেশ করেন। জামায়াতে ইসলামী সে সময় থেকে ৬ দফাকে কেন্দ্রের শাসনবিরোধী বলে প্রচার চালাতে থাকে।
শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় শত বিরোধিতা, কারাবাস, নির্যাতন উপেক্ষা করে আন্দোলন এগিয়ে নেন। শাসকগোষ্ঠী তাকেসহ বাঙালি আমলা, সেনাবাহিনীর মেধাবী সদস্য, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদদের ফাঁসানোর জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। কিন্তু ছাত্রসমাজ ১১ দফা দাবিতে রাজপথে নামে। আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রেসকোর্সে এক সংবর্ধনায় তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে। ১৯৭০ সালে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। এ সময় ভাসানী ন্যাপসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনকে ‘৬ দফার প্রতি গণভোট’ হিসেবে গ্রহণ করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্তে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে বাঙালিরা রাস্তায় নামে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, মিছিল-মিটিং ইত্যাদি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ শুধু রাজনৈতিক ভাষণ নয়; কূটনৈতিক ভাষণও। এর মাধ্যমে তিনি জাতিকে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা দেন। আর ২৬ মার্চ ঘোষণা দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। তার সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার ‘ধানশালিকের দেশ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু সংখ্যায় লিখেছেন, ‘গ্রামের আর দশটি ছেলের মতোই তিনি থেকে যেতে পারতেন গ্রামে, বড়জোর আইএ-বিএ পাস করে একটা চাকরি, কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু না, টুঙ্গিপাড়ার সেই লম্বা, সবার উপরে মাথা তোলা ছেলেটি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করতে চাননি; তিনি চেয়েছিলেন বাংলার জনগণের অধিকার; অধিকার থেকে স্বায়ত্তশাসন এবং তা থেকে স্বাধীনতা। বাংলার মানুষের নাড়ির স্পন্দন আরও দুই নেতা শেরে বাংলা ও মওলানা ভাসানী; কিন্তু সেই স্পন্দনকে যে স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যায়, তা তার মতো কেউ সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। জাতীয় নেতাদের সঙ্গে জাতির পিতার পার্থক্য এখানেই।’
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সত্তার দুটি নাম। কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।’ তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, কারাজীবন, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা তথা জনগণকে বোঝার দূরদৃষ্টি ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃষ্টান্ত আমাদের চলার পথের পাথেয়।
একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক, এটাই প্রত্যাশা করি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এ লড়াকু নেতা বেঁচে থাকবেন আমাদের মেধা, মননে ও আদর্শে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’ অভিভাষণটির একটি কথা মনে করতে পারি- ‘কোনো কোনো মুহূর্ত আসে, ইতিহাসে হয়তো তা খুব কমই আসে, যখন আমরা পুরনো থেকে নতুনের দিকে যাত্রা করি- যখন কোনো যুগের অবসান হয়, তখন কোনো জাতি অবদমিত আত্মা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায়।’
বাঙালি জাতির আত্মাও যখনই অবদমিত হয়েছে, শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছে, তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার আরেক নাম তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সূত্র: চাঁপাইনবাবগঞ্জ