নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভিশন-২০৪১ সামনে রেখে আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ‘বড় সম্ভাবনা’ কাজে লাগানো এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে সুইজারল্যান্ড আগ্রহী বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূত।
রাষ্ট্রদূত নাথালি শিউয়াখ নিজ বাসভবনে ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক খুব দৃঢ়। আমার সামগ্রিক অগ্রাধিকার এবং লক্ষ্য এই সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করা।’
উভয়পক্ষ আগ্রহী হওয়ায় দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করাই লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশে আগমনের পর গণমাধ্যমের সাথে প্রথম আলোচনায় রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা প্রচুর সম্ভাবনা দেখছি, সেটি বাংলাদেশের দিক থেকে হোক বা সুইজারল্যান্ডের। সুতরাং, অবশ্যই এটি অন্যতম অগ্রাধিকার।’
সুইস পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত বছর পর্যন্ত তা পৌঁছেছে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ডলারে।
বড় মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারিসহ প্রায় শতাধিক সুইস সংস্থা বাংলাদেশের সাথে বা দেশে ব্যবসা করছে।
রাষ্ট্রদূত শিউয়াখ বলেন, দু’দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সাথে ‘উন্মুক্ত আলোচনা’ প্রত্যাশা করছেন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সমতা এবং সবার জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশের সাথে কাজ অব্যহত রাখতে চায় উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত শিউয়াখ বলেন, ‘আমরা এখন আমাদের ভবিষ্যতের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ২০২২-২০২৫ পরিকল্পনা করছি এবং আমাদের লক্ষ্য এসডিজি ও বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের সাথে সমন্বয় করে কাজ করা।’
সুইস বিনিয়োগ
বাংলাদেশে সুইস বিনিয়োগগুলো মূলত রাসায়নিক, ওষুধ, নির্মাণ, প্রযুক্তি পরিষেবা এবং গতিশীল বিভিন্ন ভোক্তা পণ্যকেন্দ্রীক।
বাংলাদেশে শীর্ষ প্রায় সব সুইস মাল্টিন্যাশনাল সংস্থার উপস্থিতি রয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে তারা তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে সুইস বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এক প্রশ্নের জবাবে সুইস রাষ্ট্রদূত বলেন, অবকাঠামোগত সুবিধার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে।
ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে এবং সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে উল্লেখ করে সুইস রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি আশা করি, এখানে আমার আমলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর হবে।’
যদিও রাষ্ট্রদূত শিউয়াখের মতে, আইনি সুরক্ষার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসায় পরিচালনা এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়িক পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আরো উন্নতি করার জায়গা রয়েছে।
‘সুইস এবং অন্যান্য বিদেশি সংস্থাগুলো একবার ইতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করলে, তারা তাদের ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত করতে থাকবে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমি অনেক অগ্রগতি এবং ইতিবাচক লক্ষ্য দেখতে পাচ্ছি। সংস্থাগুলো সাধারণত যে ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকে, সেগুলো কার্যকরভাবে সমাধান করার জন্য আমরা আলোচনা অব্যহত রাখব,’ বলেন তিনি।
ব্যবসায়ের পরিবেশের আরও উন্নতি হলে তা নতুন নতুন সংস্থাগুলোকে এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত শিউয়াখ বলেন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ উভয়ের জন্যই লাভজনক।
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকলেও, বাংলাদেশের অগ্রগতি ‘খুবই দুর্দান্ত’, বলেন তিনি।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাধা দূর করার বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
‘এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি বৈঠক ছিল এবং ব্যবসায়ের পরিবেশসহ কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি,’ বলেন রাষ্ট্রদূত।
সুইস রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি নিশ্চিত আরো বেশি সংস্থা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে খুব সহয়তামূলক আচরণ দেখা যাচ্ছে।’
বাংলাদেশের পুনরুদ্ধার
রাষ্ট্রদূত শিউয়াখ জানান, কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের পর বাংলাদেশ আবারো মূল স্রোতে ফিরে আসছে দেখে তিনি আশাবাদী।
‘আমরা বাংলাদেশের পুনরুদ্ধার এবং সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়েছি,’ বলেন তিনি।
তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয় এটি সমগ্র বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়, কারণ কোভিড-১৯ মহামারিজনিত কারণে প্রতিটি রাষ্ট্রই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে আসা প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রদূত শিউয়াখ বলেন, ‘সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়। আমরা বাংলাদেশসহ অন্য সবাইকেই নিরাপদ দেখতে চাই।’
সংকট মোকাবিলায় ৭০ কোটি টাকার সম্পদ পুনবরাদ্দ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সংকটের এই সময়ে সহায়তা করার জন্য সুইজারল্যান্ড সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, সংহতি এখনো আছে এবং এটি শেষ হয়নি। ‘এখনো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রয়োজনে প্রকল্পগুলো চালু রেখেছি।’
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকেই বাংলাদেশে অবস্থিত সুইস সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর
সুইজারল্যান্ড ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রদূত শিউয়াখ বলেন, দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘এটি আমাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সম্পর্ক বিদ্যমান।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের সাথে সুইজারল্যান্ডের সম্পর্ক অনেকটা উন্নয়ন সহযোগিতা ও মানবিক সহায়তায কেন্দ্রীক হলেও এখন এটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত হয়েছে।
‘ভিশন ২০৪১ গ্রহণ করার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এমন সময়ে এখানে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত সম্মানিত এবং উচ্ছ্বসিত,’ বলেন তিনি।
সুইস রাষ্ট্রদূত নাথালি শিউয়াখ বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব সমৃদ্ধির জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সবাই সেই সমৃদ্ধি থেকে উপকৃত হতে পারে।