শনিবার , ডিসেম্বর ২১ ২০২৪
নীড় পাতা / সাহিত্য ও সংস্কৃতি / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: একটি জনযুদ্ধের প্রতিকৃতি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: একটি জনযুদ্ধের প্রতিকৃতি

রেজাউল করিম খান

বলা হয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। স্বপক্ষে যুক্তি আছে, সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভােেব এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিল, মিটিং ও গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দিতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতেন। প্রত্যক্ষভাবে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এইসব কারণে এটিকে জনযুদ্ধই বলা যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। সর্বক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান অংশপ্রাপ্তির হিসাব দেখে মানুষ ক্ষুব্ধ হতে থাকে। আওয়ামী লীগ এই বিষয়টিকে পুঁজি করে প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মন জয়ে সমর্থ হয়। এক পর্যায়ে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে অখন্ড পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের আয়োজন করতে থাকে, সঙ্গত কারণেই। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি বাঙালিদের সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। ততদিনে অবশ্য বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, আর তার জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে আনেক।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়াার সাথে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। সেই বৈঠক ব্যর্থ হলে শেখ মুজিব সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন। তিনি বলেন, অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে হবে। নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে। ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অতঃপর তিনি ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তার এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে।

মুক্তিযুদ্ধে এত ব্যাপকভাবে সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। নয় মাসের দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনসাধারণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কবি-সাহিত্যিক-লেখক, সরকারী কর্মকর্তা, সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ, আইনজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতী, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ সর্বোতভাবে অংশগ্রহণ করে বলেই এটি একটি জনযুদ্ধে পরিণত হয়। এরই সফল পরিণতি ছিলো পাকিস্তানী হানাদার, যারা ছিলো এক সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন। কিন্তু কেনো এই যুদ্ধ? কী চাওয়া ছিল মানুষের? আগেই বলেছি, পাকিস্তান সৃষ্টির পর বৈষম্যই ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে ক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারণ। আর ছিল পাকিস্তানী শাসকদের বাংলা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা। সর্বোপরি পাকিস্তানের ২২ কোটিপতি পরিবারের বিরুদ্ধে বাঙালি উঠতি পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্ব। চাওয়া ছিল, বৈষম্যের অবসান। বাঙালি সম্প্রদায়কে তাদের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হতো। পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদির ফলে বাঙালিরা পাকিস্তানের অন্য নাগরিকদের তুলনায় নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যারা হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিল, তাদের অন্যান্য বাঙালির তুলনায় অধিকতর বৈষম্যের শিকার হতে দেখা গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সেই দাবি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে স্বকীয়তা রক্ষা, বৈষম্যের অবসান এবং নানা ধরনের সামাজিক অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তির জন্য তাদের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো প্রয়োজন; যার শাসন ও পরিচালন ভার নিতে হবে তাদের নিজেদের হাতে; এ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। সে কারণে বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান ভূখণ্ডের পূর্ব পাকিস্তান অংশ আলাদা হয় এবং সেখানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যূদয় হয়।

আবারও বলি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রায় জনযুদ্ধ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জনযুদ্ধ সবসময়ই উপেক্ষিত। কারণ যুদ্ধ পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় জনগণের দুর্বল অবস্থান। কখনোবা প্রায় অনুপস্থিতি। জনযুদ্ধ উপেক্ষিত হওয়ার কতিপয় কারণ : মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রশাসন চলে যায় পাকিস্তানি ভাবাদর্শের কর্মকর্তাদের হাতে। স্বাধীনতা লাভের পরপর রাজনৈতিক সরকারকে ব্যস্ত থাকতে হয় নাগরিক অস্তিত্ব রক্ষায়। এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা রক্ষায় পাকিস্তানি বশংবদদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। যারা একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরও তারা যুদ্ধপরবর্তীকালে সাদা কাগজে মুচলেকা দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে বহাল থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আনুগত্য তাই প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়। যার প্রমাণও অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট। ফলে এই প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের মূলধারাকে সামনে আনবে এটা অস্বাভাবিক। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সরকারের প্রশাসনে নীরব কর্মকর্তাদের শ্রেণিগত অবস্থানও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন কিংবা মুক্তিযুদ্ধকে ঊর্ধে তোলার মানসিকতা সম্পন্ন ছিল না। সেটাও তাদের অবস্থানগত কারণে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তাদের শ্রেণির মানুষের হার ছিল খুবই কম। স্বাধীনতা লাভের পর পুরো প্রশাসনেই ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেয়া লোকদের প্রাধান্য। এই অবস্থায় নিজ শ্রেণি স্বার্থ নেই বিধায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মূল্যায়ন পিছিয়ে পড়ে। আবার সামাজিক দিক দিয়েও যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলেও দেখা যাবে জনযুদ্ধ পিছিয়ে থাকার কারণ বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক অবস্থান ছিল তৃণমূলে। আর্থিক বিবেচনায় তারা ছিলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্তদের প্রাধান্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। ফলে স্বাধীনতা লাভের পর যখন প্রশাসন ও সামাজিক শাসন শুরু হয়, কর্তা ব্যক্তিদের শ্রেণি বহির্ভূত বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়।

সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থসমূহ, সংবাদপত্র, গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আতিউর রহমান, মোস্তফা হোসেইন, আবীর আহাদ, কাবেদুল ইসলাম প্রমুখ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট

আরও দেখুন

লালপুরে কুরেছান বেগমের ইন্তেকাল 

নিজস্ব প্রতিবেদক লালপুর,,,,,,,,,,,,,,দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার নাটোরের লালপুর প্রতিনিধি ও মডেল প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সাহীন …