নিজস্ব প্রতিবেদক:
- দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অসংখ্য গ্রাম ও স্থাপনা গিলে খাচ্ছে নদী
- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভাঙ্গন কবলিতদের পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে এক শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ
খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশের নদী শাসন ও স্থায়ীভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেছে শেখ হাসিনার সরকার। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় নদীরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার প্রকল্প নিয়েও দিনরাত কাজ করে চলেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পরিকল্পিত এসব প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে স্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলবাসী ও গোটা দেশের নদীপাড়ের বাসিন্দাদের রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। উজানের পলি এসে একদিকে যেমন নদী ভরাট হচ্ছে, অপরদিকে তীব্র স্রোতের কারণে সারাদেশের বিভিন্ন নদীতে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নদী ঘেরা বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ভাঙ্গন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
এতদিন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দিনরাত নদী ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। ড্রেজিং করে নদীর পলি সরানোর পর পরই আবারও পলিতে ভরে যাচ্ছে। পাশাপাশি নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা। তেমনি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি, সরকারী-বেসরকারী অসংখ্য স্থাপনা, হাট-বাজার, নদী তীরবর্তী ঘরবাড়ি, মসজিদ ও গাছপালা।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুক শামীম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে নদীরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া নদী শাসন ও স্থায়ীভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধে বিভিন্ন এলাকায় প্রকল্প গ্রহণ করেও কাজ শুরু করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সারাদেশে নদী ভাঙ্গনকবলিত এলাকার জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন করছেন। এসব তালিকা তৈরির পর ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল ও দেশের বিভিন্ন এলাকার ভাঙ্গনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে স্ব-স্ব এলাকার জনপ্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নদী ভাঙ্গন স্থায়ীভাবে প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নেয়া হয়েছে।
বিদেশী প্রযুক্তির মাধ্যমে টেকসই প্রকল্প ॥ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুক শামীম এমপি বলেন, কুয়াকাটা ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে সরকার। ইতোমধ্যে পাউবোর সচিব ও মহাপরিচালকসহ একটি প্রতিনিধি দল নেদারল্যান্ডস ভ্রমণ করেছেন। সেখানকার জনগণের জন্য নদী ও সমুদ্র ভাঙ্গনরোধে যে ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে একইভাবে ওই দেশের প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেকসই বেড়িবাঁধসহ স্থায়ীভাবে ভাঙ্গনরোধে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এ জন্য নদী ও সমুদ্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে স্থায়ীভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রকল্প তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই শেষে একনেকে পাঠানো হবে। এছাড়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উন্নয়নে একটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে বলেও প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
মেহেরবানি করে নদী তীরের গাছগুলো কাটবেন না ॥ বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ লামচরি বেড়িবাঁধ এলাকা অতি সম্প্রতি পরিদর্শনে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুক শামীম এমপি বলেছেন, মেহেরবানি করে নদীর তীরের গাছগুলো কেউ কাটবেন না। আমফানের পর আমরা সাতক্ষীরাতে দেখেছি যেখানে নদীর তীরে গাছ ছিল সেসব স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়নি। আর যেসব জায়গায় গাছ ছিল না সেখানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
নদীর ভাঙ্গন প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজ অন্যদের মতো নয়; একেক জায়গার নদীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেক রকম। এটাকে বিচার-বিবেচনা করে আমাদের টেকনিক্যাল কমিটি দেখে এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কীভাবে কাজ করতে হবে। কোন জায়গায় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, আবার কোন জায়গায় ড্রেজিং করতে হবে। এজন্য সময় লাগে। আর সময় নিয়েই এবার ভাঙ্গন প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা নদীতে ড্রেজিং করি, তীর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করি। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু লোক এসে নদীর তীর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে, এতে নদীর তীর ভেঙ্গে যায়। আর আমরা বাঁধ নির্মাণ করলে তাও ভেঙ্গে যাবে। অসাধু বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
দেশের সবগুলো নদী শাসনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ॥ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব নদী শাসন ও ড্রেজিং করতে নির্দেশ দিয়েছেন। নদীভাঙ্গনের কারণ তুলে ধরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা ভাটির দেশের মানুষ, তাই উজানে বন্যার সৃষ্টি হয়। নদী ভাঙ্গনের ফলে পানির সঙ্গে পলি নেমে আসে। প্রতিবছর নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠছে এবং নদীর গতিপথও পরিবর্তন করছে। প্রতিবছর ভাঙ্গন রোধে বাঁধ দেয়া হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ স্থায়ী করতে কিছুটা সময় লাগছে। স্থায়ী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কিছুটা বিলম্বও হবে। এজন্য ভাঙ্গনকবলিত এলাকার মানুষকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। বিগত সরকার নদী শাসনে তেমন কোন অর্থ ব্যয় করেনি। করোনার কারণে আমাদের কাজের অগ্রগতি কিছুটা ধীরগতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রী দেশের সবগুলো নদী শাসন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর শেখ হাসিনার মতো প্রধানমন্ত্রী এ দেশের মানুষ কখনও পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না থাকলে দেশে নতুন করে আর কোন উন্নয়ন হবেনা, থেমে যাবে চলমান প্রকল্পগুলোও।
নদীগর্ভে বিলীন সরকারী স্কুল ভবন ॥ রাক্ষসী কালাবদর, তেঁতুলিয়া, গণেশপুরা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা। আর সেই নদীভাঙ্গনেই ২০১৭ সালে নির্মিত শ্রীপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের চরবগী চৌধুরীপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনটি সম্প্রতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ নিয়ে গত তিনবছরে শ্রীপুর ইউনিয়নের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
শ্রীপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বশিরুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৭ সালে দ্বিতল পাকা ভবনের এ বিদ্যালয়টি নির্মাণের সময় নদীর অবস্থান ছিল বহু দূরে। গত দুই বছরের তীব্র ভাঙ্গনে বিদ্যালয় ভবনের কাছাকাছি চলে আসে নদী। গত ২৬ আগস্ট দুপুরে বিদ্যালয় ভবনটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ভাঙ্গন প্রতিরোধে বিদ্যালয়সংলগ্ন নদীতে বালুর বস্তা ফেলেও শেষ রক্ষা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এর পূর্বে চরবগী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে প্রায় দশ কিলোমিটার লম্বা সড়কের দুপাশে অসংখ্য ঘরবাড়ি ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরের ব্যবধানে নদীভাঙ্গনে সড়কসহ ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদী গ্রাস করে নিয়েছে .
মেঘনার ভাঙ্গনে হুমকির মুখে শতবর্ষী বাতিঘর ॥ প্রমত্তা মেঘনার প্রতি মুহূর্তের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বিদ্যালয় ভবনের দেয়ালে। যে কোন সময় মেঘনায় বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে চরের শিশুদের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত বিদ্যালয়টি। ভবনটি মেঘনায় হারিয়ে গেলে সমাপ্ত হবে ১০২ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী বরিশালের হিজলা উপজেলার ধুলখোলা ইউনিয়নে শতবর্ষী পিএন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠানটি রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬শ’ মিটার বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ বিদ্যালয়টি ধুলখোলা ও পার্শ¦বর্তী হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন মেঘনাবেষ্টিত জনপদে ‘চরের বাতিঘর’ হিসেবে পরিচিত। হিজলা উপজেলা শিক্ষা অফিসার কাজী শফিউল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, নদীভাঙ্গনের হুমকির মুখে থাকা বিদ্যালয়টির বর্তমান অবস্থা সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। পাউবোর স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন করা হলে এ প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা পাবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যালয়ের মূল ভবন থেকে মেঘনা এখন মাত্র ২০ ফুট দূরে। প্রতি মুহূর্তে মেঘনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে একমাত্র দ্বিতল পাকা ভবনের পূর্বপাশের দেয়ালে। চলমান নদীভাঙ্গনে এ ভবনটি বিলীন হলে পুরো প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এর পূর্বে গতবছর বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত শ্রেণীকক্ষ ভবন, লাইব্রেরি ভবন এবং সংলগ্ন আশিকর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার ভবন।
ধুলখোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইকবাল হোসেন মাতুব্বর জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মেঘনার ভাঙ্গনে এ পর্যন্ত তিনবার বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় থাকা বিদ্যালয়টি রক্ষার জন্য গতবছর পাউবোর উদ্যোগে ব্লক ফেলে বাঁধ দেয়া শুরু হয়েছে। এ কাজের প্রথম প্রক্রিয়ায় জিও ব্যাগ ফেলা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে জিওব্যাগ না ফেলার কারণে প্রবল জোয়ারে জিওব্যাগ তলিয়ে গেছে।
ছোট হয়ে আসছে মুলাদীর মানচিত্র ॥ বরিশালের মুলাদী উপজেলায় অব্যাহত নদীভাঙ্গনের মুখে বিলীন হয়ে যেতে শুরু করেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। রাক্ষসী জয়ন্তী, আড়িয়াল খাঁ, ছৈলা ও নয়া ভাঙলী নদী তীরে ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। অব্যাহত নদীভাঙ্গনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে উপজেলার মানচিত্র। নদীভাঙ্গনে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। রাস্তাঘাট নদীতে ভেঙ্গে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
জয়ন্তী ও ছৈলা নদীর ভাঙ্গনে উপজেলার উত্তর চরগাছুয়া, কৃষ্ণপুর, ষোলঘর, চরমালিয়া, ব্রজমোহন, বালিয়াতলী, ঘুলিঘাট, সেলিমপুর, আলিমাবাদ ও ভাঙ্গারমোনা গ্রামগুলো চরম হুমকির মুখে পড়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে নাজিরপুর, রামারপোল, কাজিরচর, সাহেবেরচর, বানীমর্দন, নবাবেরহাট, নন্দিরবাজার, চিলমারী, পশ্চিম চরকালেখান, পাতারচর গ্রামের অধিকাংশ এলাকা ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুক শামীম নদীভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করে বাটামারা ও সফিপুর ইউনিয়নের দুটি গ্রামে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ফেলার উদ্বোধন করেন। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন ও নদীর পাড়ের মাটি বিক্রি করায় নদীভাঙ্গন বেড়েই চলেছে।
স্থানীয়রা আরও জানান, মুলাদী সদরের প্রভাবশালী জুয়েল হাওলাদার, শাহাদাত হোসেন ও মামুন হাওলাদারের মালিকানাধীন অবৈধ ড্রেজার দিয়ে সফিপুর ইউনিয়নের জয়ন্তী নদীতে প্রভাব খাটিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী আরিফ মুন্সী, রিপন মোল্লা ও হিরন মুন্সীর অবৈধ বালু বাণিজ্যের কারণে ভাঙ্গনের হুমকির মুখে পড়েছে জয়ন্তী নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা।
সূত্রে আরও জানা গেছে, ছৈলা, জয়ন্তী ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনরোধে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে মুলাদীর মানচিত্র থেকে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে নাজিরপুর, সফিপুর, বাটামারা ও রামচরসহ কয়েকটি গ্রাম। ইতোমধ্যে নাজিরপুর ইউনিয়নের পুলিশ ফাঁড়ির পশ্চিম পাশে নদীতে ফেলা সিসি ব্লক ও জিও ব্যাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙ্গনে হুমকির মুখে পড়েছে সফিপুরের ব্রজমোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাজী সৈয়দ বদরুল হোসেন কলেজ, নাজিরপুর ইউনিয়নের চর নাজিরপুর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাটামারা ইউনিয়নের এবিআর মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য হাট-বাজার।
দক্ষিণাঞ্চলে অনেক জনপদ ও সম্পদ গিলে খাচ্ছে নদী ॥ বর্ষা বিদায়ের লগ্নে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে অবিরাম বর্ষণের ফলে বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে জনপদ। বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, তীব্র জনবল সঙ্কটের মধ্যেও রয়েছে পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব। এর মধ্যেও বাঁধ নির্মাণ ও নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখছেন।
সূত্রমতে, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে নদীর ভাঙ্গন রোধসহ নদী শাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ইতিপূর্বে ৩১টি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে বরিশাল জেলার আটটি স্থানে নদীভাঙ্গন রোধে প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা, পটুয়াখালীর তিনটি নদীভাঙ্গন রোধ প্রকল্পের জন্য প্রায় ছয়শ’ কোটি টাকা, ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙ্গন থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রক্ষায় আটটি প্রকল্পের জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও কালিজিরা নদীর ভাঙ্গন থেকে নৌ-বাহিনীর আঞ্চলিক বেজ স্টেশনসহ ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা এবং বরগুনার তিনটি প্রকল্প বাস্তায়নে ৪২৭ কোটি টাকার প্রকল্প-প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে।
এছাড়াও পিরোজপুরের দুটি প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকার প্রয়োজন। তবে জেলার ভা-ারিয়া উপজেলার এই দুটি প্রকল্প জিওবির তহবিলসহ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। অপরদিকে সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গন থেকে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের দোয়ারিকার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু ও এর সংযোগ সড়ক রক্ষায় প্রায় আট বছর আগে ১১ কোটি টাকার প্রকল্প-প্রস্তাব অনুমোদন না হওয়ায় এখন একই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে প্রায় ২৩৫ কোটি টাকা। এ সংক্রান্ত প্রকল্প-প্রস্তাবনাটি গত ১০ মাস আগে একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করলে এখনও তা দরপত্র পর্যায়ে রয়েছে।
২০১৭ সালের নবেম্বরে বরিশাল নগরী সংলগ্ন চরবাড়িয়া এলাকার কীর্তনখোলা নদীর ভাঙ্গন রোধে ৩৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও তার বাস্তবায়নও বিলম্বিত হচ্ছে, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে অর্থ সঙ্কটের কারণে। সরকারী নির্দেশনার আলোকে প্রকল্পটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন খুলনা শিপইয়ার্ড বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতির সঙ্গে অর্থ ছাড় না করায় প্রকল্পের কাজ কাক্সিক্ষত মাত্রায় এগুচ্ছে না। গত অর্থবছরে প্রকল্পটির জন্য ৫০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে পাঁচ কোটি টাকারও কম।
সূত্রমতে, মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, বিষখালী ও পায়রাসহ বড় নদ-নদীগুলো উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে ভাঙ্গছে দক্ষিণাঞ্চলের একের পর এক জনপদ ছাড়াও সরকারী-বেসরকারী স্থাপনাসমূহ। একই অবস্থা বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ ও বিমানবন্দরের উত্তর প্রান্তের সুগন্ধা নদী তীরের মানুষের। সুগন্ধার বুকে বিলীন হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু সংলগ্ন একটি মাধ্যমিক স্কুল ভবনসহ মসজিদ ও একটি সাইক্লোন শেল্টার কাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কুয়াকাটা সাগর সৈকত ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আঘাত হানলেও গত দশ বছর ধরে শুধু নানা ধরনের গবেষণা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অতি সম্প্রতি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম সরেজমিনে কুয়াকাটা পরিদর্শন করে ভাঙ্গন রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভোলায় ভাঙ্গন রোধে একাধিক প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তব কার্যক্রম শুরু হলেও অর্থের অভাবে গতি ক্রমশ ধীর হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে এখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নদীভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত মানুষের আহাজারি।
থাকছেনা সনাতনি পদ্ধতি ॥ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অতীতের সনাতনি পদ্ধতি ছোট ছোট, ক্ষুদ্র কিংবা বিক্ষিপ্ত প্রকল্প বাদ দিয়ে নদীভিত্তিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করে নদী শাসন ও স্থায়ীভাবে ভাঙ্গন প্রতিরোধে কাজ শুরু করা হয়েছে। পরিকল্পিত এসব প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে স্থায়ীভাবে নদীর ভাঙ্গন থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলবাসী ও গোটা দেশের নদীপাড়ের বাসিন্দাদের রক্ষা করা সম্ভব হবে।