নিউজ ডেস্ক:
সবুজ পাহাড় ও লেকঘেরা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। জীববৈচিত্র্যময় এই জেলায় রয়েছে সুউচ্চ শ্যামল পাহাড়, নদী ও ঝর্ণাধারা। আছে প্রাকৃতিক সম্পদের ভা-ার। দেশের দ্বিতীয় পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাত এই জেলা।
এই জেলায় সমতল ভূমির পরিমাণ কম। রয়েছে অগণিত ছোট বড় পাহাড়। প্রতিটা পাহাড় অত্যন্ত উর্বর। এখানে পাহাড়ে সোনা ফলে। এখানকার ফল অত্যন্ত সুস্বাদু। কমলা, মাল্টা, আম, লিচু, কাঁঠাল, ড্রাগন কলা, পেঁপে, জা¤ু^রাসহ হরেক রকমের ফল। এই সরকার চাষীদের প্রতি সুনজর দেয়ায় এসব ফল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। আবার এই শ্যামল পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে নয়ন জুড়ানো ঝরনা ও নানা ধরনের পশুপাখি। যা দেখার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য পর্যটক। এই জেলার উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। গত ১৩ বছরে বর্তমান সরকারের আমলে যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য, কৃষি ও পর্যটন খাতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন করেছে। যা চোখে পড়ার মতো। সরকার এখনও বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়ন করে যাচ্ছে। ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম জেলা থেকে ১৩ হাজর বর্গ কিঃমি পাহাড়ী অঞ্চলকে নিয়ে গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখান থেকে জেলার দক্ষিণে মিয়ানমার সীমানা নিয়ে ১৯৭৯ সালে সৃষ্টি করে বান্দরবান পার্বত্য জেলা। এরপর জেলার উত্তর অংশকে নিয়ে ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা গঠন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা হয়ে গেল রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। ১৬১ বছরের পুরনো এই জেলা বরাবরই অবহেলিত অবস্থায় ছিল। এর আয়তন ৬,১১৬ বর্গ কিঃমিঃ আর লোকসংখ্যা ৬ লাখের উপরে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বিরাজমান পরিস্থিতি নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএস নেতা জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। এরপর থেকে শুরু হয়েছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গত ১৩ বছরে ১৮৭৮ কোটি টাকার উন্নয়ন করেছে। তাদের প্রধান উন্নয়ন কাজ হলো সেতু, সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ী পল্লীর শিশু উন্নয়নের জন্য ৪,৭০০ পাড়া কেন্দ্র স্থাপন করে পাহাড়ে ৫৫ হাজার শিশু শিক্ষার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী এই পাড়া কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
পর্যটন ॥ এই জেলার দক্ষিণে রাইক্ষং লেকের মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে শুরু হয়ে উত্তরে ভারত সীমান্তের সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত প্রায় ৩ শত কিঃমিঃ সড়ক পথ হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহর থেকে মেঠো পথে সাজেকে যেতে সময় লাগত ৭২ ঘণ্টা। এখন সড়ক উন্নয়নের বদৌলতে সেখানে যেতে সময় লাগে মাত্র ৩ ঘণ্টা। বাংলার দার্জিলিং হিসেবে খ্যাত সাজেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১৮শ’ ফুট উচ্চতার এই সাজেক ভ্যালিতে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিতালি একনজর দেখার জন্য দেশ-বিদেশের পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। এটি ছাড়াও রাঙ্গামাটিতে ফোরমুন পাহাড়ের চূড়ায় উঠার সিঁড়ি করায় সেখানেও প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। সাজেক আর ফোরমুনের রাতের দৃশ্যটাই অন্য রকম। মেঘের সঙ্গে বিজলি বাতির ঝিলিমিলি দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন পাহাড়ের শীর্ষে জোনাকি পোকার মেলা বসছে। রাঙ্গামাটিতে সেনা রিজিয়ন আরণ্যক নামে একটি পর্যটন কেন্দ্র করেছে। নৌবাহিনী কাপ্তাই এলাকায় দেখার মতো অপর একটি পর্যটন কেন্দ্র করেছে। পুলিশ বাহিনীও পলওয়েল পার্ক নামে রাঙ্গামাটি শহরের লেকের পাশে অন্যরকম একটি পর্যটন কেন্দ্র খুলেছে। এছাড়া শুভলং ঝরনা, কাপ্তাই লেক, রাজবাড়ি, পর্যটন কমপ্লেক্সসহ রাঙ্গামাটিতে অসংখ্য পর্যটন স্পট রয়েছে। যেগুলোর উন্নয়ন বেশ চোখে পড়ার মতো।
সড়ক উন্নয়ন ॥ রাঙ্গামাটিতে বিগত ১৩ বছরে সড়ক উন্নয়নে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে সড়ক বিভাগে ১৭৮ কিঃমিঃ সড়ক রয়েছে। রাঙ্গামাটি থেকে সাজেক পর্যন্ত ১৪০ কিঃমিঃ সড়ক পাকা রয়েছে। এছাড়াও আরও ৯৬ কিঃমিঃ সড়কের মেরামত কাজ হয়েছে। ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫শ’ মিটার দীর্ঘ চেঙ্গী নদীর ওপর নানিয়ারচর ব্রিজ করা হয়েছে। যা উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানায় সড়ক বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহে আরেফিন। একইভাবে এলজিইডি ১৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৭ কিঃমিঃ সড়ক ১৫৪০ মিটার ব্রিজ করা হয়েছে বলে নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তালেব চৌধুরী জানান। ২১০ কোটি টাকার জুরাইছড়ি ব্রিজের কাজ চলমান রয়েছে।
রাঙ্গামাটি জেলার সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩১৭ কিঃমিঃ সীমান্ত সড়কের কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে অতিরিক্ত চীফ নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল ওয়াহিদ জানান। এই সড়ক নির্মাণ শেষ হলে জেলায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম অনেকটা কমে যাবে। এই সড়কে ইতোমধ্যে ৫৫কিঃমিঃ মাটির কাজ সমাপ্ত হয়েছে বলে সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
রাঙ্গামাটির প্রতিটা পাহাড়ের চূড়ার টংঘরে জ্বলছে এখন বিজলি বাতি। এই সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় পাওয়া যাচ্ছে মোবাইলে নেটওয়ার্ক। পাহাড়বাসীর জন্য এটি একটি স্বপ্ন। গত ৫ বছরে ৫৬০ কোটি টাকার বিদ্যুতের কাজ হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩ হাজার কেভি বিদ্যুত লাইন বসেছে ২৫২ কিঃমিঃ ১১ হাজার কেভি লাইন বসেছে ১৬ শত কিঃমিঃ ট্রান্সফরমার বসেছে ৩৩/১১ কেভি ১৬টি। এই সব কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদ্যুত উন্নয়ন প্রকল্পের প্রজেক্ট ডিরেক্টর উজ্জ্বল বড়ুয়া এই তথ্য জানান।
রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ গত ১৩ বছরে ২০৯ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছে বলে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংশুপ্রু চৌধুরী জানায়।
রাঙ্গামাটিতে বহুল আলোচিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। সরকার ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমা জানান।
রাঙ্গামাটির সার্বিক উন্নয়ন সম্পর্কে রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এমপি বলেছেন, জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে এই অঞ্চলের মানুষের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি করেছেন। এই চুক্তিকে বাস্তবরূপ দিতে তিনি পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পাহাড়ের আনাচে কানাচে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। আমি আশা করি বর্তমান সরকার এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের বিষয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছেন পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন করার জন্য। এই সরকার পার্বত্যাঞ্চলের দুর্গম পল্লীর উন্নয়ন করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন করে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন। তার জন্য পার্বত্যবাসী অত্যন্ত আনন্দিত।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংশুপ্রু চৌধুরী রাঙ্গামাটির উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে বলেছেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে জেলা পরিষদ সৃষ্টি করে এই এলাকার উন্নয়নের চলমান ধারাকে আরও গতিশীল করেছে। জেলা পরিষদ উন্নয়নের পাশাপাশি এখানকার শিক্ষা সংস্কৃতি ও সম্প্রীতি উন্মেষ ঘটিয়েছেন। এই জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ সহসভাপতি শহিদুজ্জমান মোহসিন রোমান পাহাড়ের উন্নয়ন বিষয়ে বলেন, জাতির জনক যেভাবে পাহাড়ের মানুষকে ভাল বেসেছেন তেমনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ের অবহেলি মানুষকে ভালবেসে শান্তিচুক্তি করে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন। বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে যে হারে উন্নয়ন হচ্ছে, তা চলমান রাখার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিকট অনুরোধ করেছেন।
রাঙ্গামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী পৌরসভার উন্নয়নের বিষয়ে বলেছেন, বর্তমান সরকার রাঙ্গামাটির উন্নয়নের জন্য সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলে জানান। তার সময়ে রাঙ্গামাটি পৌরসভা উন্নয়নের জন্য প্রায় ৯০ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছে। যার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।