নিউজ ডেস্ক:
অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, নৌ-ডুবিসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায় সবার আগে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নালায় কিংবা ডোবায়, সুউচ্চ বহুতল ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলা ও জানমালের নিরাপত্তায় বিচক্ষণতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। বিপদে ভরসাস্থলে পরিণত হতে পারলেও আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সংস্থাটি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষ করে বহুতল ভবনে বা বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতার চিত্র ফুটে ওঠে। তাই সেবা প্রদানের মাধ্যমে বদনাম ঘুচিয়ে আস্থা অর্জনের পথে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফলে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রাধান্য দিচ্ছে সংস্থাটি।
যদিও এর জন্য কখনই নিজেদের দুর্বলতাকে দায়ী করেনা সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, আধুনিক সরঞ্জামের সঙ্কটের কারণে নয়, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির পেছনে মানুষের সচেতনহীনতাই দায়ী। অবশ্য ছোট অগ্নিকাণ্ডগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনতে দেখা গেছে সংস্থাটিকে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০২০ সালে সারাদেশে ২১ হাজার ৭৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৭ হাজার ৭২৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। চুলার আগুন থেকে ৩ হাজার ৫৬৪টি, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো থেকে ৩ হাজার ৪৬৪টি, মেশিনের মিস ফায়ার থেকে ১৭৩টি, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণে ১৩৫টি, গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে ৭২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৫৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৯৩ জন পুরুষ, ৭৮ জন নারী এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী। এসব ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। মোট উদ্ধারের পরিমাণ এক হাজার ৪২৬ কোটি ১৮ লাখ টাকারও বেশি।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাপণের জন্য আধুনিক ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা। ১০ বছর আগে সারাদেশে ২০৪টি ফায়ার স্টেশন থাকলেও বর্তমানে সারাদেশে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা ৪৫৬টি। পাশাপাশি ঢাকা, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ ও রূপপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে ১১টি আধুনিক ফায়ার স্টেশন। কর্তকর্মাদের দাবি, ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়েনি জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম। বর্তমানে সংস্থাটি জনবল রয়েছে ১৩ হাজার ৪৭৩ জন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। জানা গেছে, প্রথম শ্রেণীর ফায়ার স্টেশনগুলোতে ৩৫ জন করে জনবল থাকার কথা। এরমধ্যে ফায়ারম্যান থাকার কথা ২২ জন। কিন্তু বাস্তবে ১৫-১৬ জনের বেশি ফায়ারম্যান নেই প্রথম শ্রেণীর স্টেশনেও। দ্বিতীয় শ্রেণীর ফায়ার স্টেশনের অবস্থা আরও করুণ। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্কট কাটাতে কমপক্ষে ৩০ হাজার জনবল দরকার বলে মনে করেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, আধুনিক সরঞ্জামের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। বর্তমানে সারাদেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২১টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ১১টি। এরমধ্যে স¤প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের ৫টি ল্যাডার যুক্ত হয়েছে। এগুলো ২২তলা পর্যন্ত আগুন নির্বাপণে সক্ষম। এছাড়াও ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসে বিশেষায়িত গাড়ি এখন প্রায় ৬শ’টি। এছাড়াও রাতে অভিযান পরিচালনার জন্য হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, রিমোট কন্ট্রোল অপারেশন ভিহাইক্যাল, কেমিক্যালে আগুন নির্বাপণে সক্ষম ৫টি অত্যাধুনিক গাড়ি, ওয়াটার রেস্কিউর জন্য রাবার বোট, বহুতল ভবনে রেস্কিউ করার জন্য ৩০ মিটার গভীরে কাজ করতে সক্ষম হ্যামার যোগ করে দুর্বলতা কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, অতীতের তুলনায় ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের সব ধরনের সরঞ্জাম আমাদের আছে। যদি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেদিক থেকেও আমরা পিছিয়ে নেই। তবে, প্রশিক্ষণের বেলায় অনেক ঘাটতি রয়েছে, এটা সত্য। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুন্সীগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। আমাদের পরবর্তী মূল ফোকাস হচ্ছে, ফায়ার একাডেমির মাধ্যমে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। এক প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, বর্তমানে ৬৮ মিটার বা ২২ তলা পর্যন্ত অগ্নি নির্বাপণের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। তবে, ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে, আগুনের সূত্রপাতের ১৫ মিনিটের মধ্যে নির্বাপণ কাজ শুরু করতে হয়। কিন্তু যানজট ও সরু রাস্তার জন্য আমরা সময়মতো পৌঁছাতে পারি না। ভবনগুলোও বিল্ডিং কোড না মানা এবং নিজস্ব কোন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সরঞ্জাম আছে পর্যাপ্ত। কিন্তু সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
বড় অগ্নিকাণ্ডে ফুটে ওঠে দুর্বলতা ॥ গতকয়েক বছরে বিভিন্ন বহুতল ভবন, কলকারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুর্বলতা ফুটে ওঠে ফায়ার সার্ভিসের। আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগায় বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে হতাহতদের পরিবার ও স্থানীয়দের। বিশেষ করে গত ৮ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রæপের হাশেম ফুড এ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ২৯ ঘণ্টা সময় লাগে ফায়ার সার্ভিসের। ততক্ষণে ৬ তলা ভবনের পুরোটাই আগুনের তাণ্ডবে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। ৪র্থ তলায় আগুন ছড়াতে কয়েকঘণ্টা সময় লাগলেও সেখানে আটকা পড়া ৪৯ শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। এছাড়াও গত বছরের গত ৫ নবেম্বর রাজধানীর ডেমরায় কোনাপাড়া মাদ্রাসা রোডে পাশা টাওয়ারের ১০তলা ভবন এবং ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণেও হিমশিম খেতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসকে।
ফায়ার পদক পাচ্ছেন ৩৭ জন \ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ৩৭ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীকে তাদের সাহসিকতা, ঝুঁকিপূর্ণ ও সেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক, প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদক এবং বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদক প্রদান করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তাদের হাতে পদক তুলে দেয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদকপ্রাপ্ত নয়জন হলেন- রাজশাহী ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ আব্দুল রউফ, টঙ্গীর সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ ইকবাল হাসান, সহকারী পরিচালকের (ঢাকা) দফতরের স্টেশন অফিসার মোঃ আল মাসুদ, সদরঘাট স্টেশনের লিডার মোঃ এবাদুল্লাহ, মধুপুরের ফায়ারফাইটার মোঃ কামরুল হাসান, পাবর্তীপুরের ফায়ারফাইটার জয়দেব চন্দ্র সরকার, সদর দফতরের ডুবুরি মোঃ আলমগীর হোসেন, ঝিনাইদহ স্টেশনের স্টাফ অফিসার শেখ মামুনুর রশিদ, লামারবাজারের (চট্টগ্রাম) ফায়ারফাইটার মোঃ আনিসুর রহমান।
প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদক প্রাপ্ত নয়জন হলেন- চট্টগ্রাম বন্দর : স্টশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ শামীম মিয়া, কাজিপুরের (সিরাজগঞ্জ) স্টেশন অফিসার মোঃ ফরিদ উদ্দিন, ঢাকা মিরপুরের স্টাফ অফিসার লাসমিন সুলতানা, খিলগাঁও স্টেশনের ফায়ারফাইটার মোঃ রুবেল আহমেদ, লংগদু স্থল কাম নদীর ডুবুরি মোঃ সোহেল মিয়া, আগ্রাবাদের (চট্টগ্রাম) সিনিয়র অফিসার মোহাম্মদ এনামুল হক, মাগুরার শালিখা স্টেশনের ফায়ারফাইটার মোঃ রমজান শেখ, হবিগঞ্জের উপসহকারী পরিচালক শিমুল মোঃ রাফি। দাউদকান্দির স্টেশন অফিসার ফয়েজ আহম্মেদ।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদকপ্রাপ্ত নয়জন হলেন- সদর দফতরের উপ-পরিচালক (অপা. ও মেইন) দেবাশীষ বর্ধন, ঢাকা জোন-২ এর উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবুল বাসার, তেজগাঁওয়ের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোঃ মাহমুদুল হাসান, কিশোরগঞ্জের স্টেশন অফিসার আবুজর গিফারী, মুুন্সীগঞ্জের স্টেশন অফিসার মোঃ ইউনুছ আলী, খুলনার ডুবুরি রাব্বি শেখ, চট্টগ্রামের সমুদ্রগামী স্টেশনের ডুবুরি মোঃ রাজিব মিয়া, সিদ্দিকবাজারের ডুবুরি জহীর উদ্দিন, রাজশাহীর ডুবুরি জুয়েল রানা।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদকপ্রাপ্ত ১০ জন হলেন- চট্টগ্রামের উপপরিচালক শামীম আহসান চৌধুরী, সদর দফতরের ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর মোঃ এনায়েত উল হক, গোবিন্দগঞ্জের স্টেশন অফিসার মোঃ আরিফ আনোয়ার, চন্দনপুরার স্টেশন অফিসার রাহুল দেবনাথ, কালকিনির ড্রাইভার গৌতম কুমার হালদার, জয়দেবপুরের ফায়ারফাইটার মোঃ আতিকুর রহমান, ময়মনসিংহের ফায়ারফাইটার মনোয়ার খান, পোস্তগোলার ফায়ারফাইটার মোঃ আনারুল ইসলাম, ময়মনসিংহেন ফায়ারফাইটার মোঃ তারা মিয়া ও লংগদু স্থল কাম নদী স্টেশনের (রাঙ্গামাটি) ডুবুরি মোঃ জামাল উদ্দিন।
ফায়ার সপ্তাহ শুরু আজ ॥ ‘মুজিববর্ষে শপথ করি, দুর্যোগে জীবন-সম্পদ রক্ষা করি’- এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে শুরু হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ-২০২১। রাজধানীর মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কমপ্লেক্সের প্যারেড গ্রাউন্ডে বেলা ১১টায় ফায়ার ডিজির সভাপতিত্বে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মোঃ মোকাব্বির হোসেন। ফায়ার সপ্তাহ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন।