স্যাটেলাইট ব্যবহারের জন্য এতদিন দেশ থেকে ডলার বিদেশে যেত। সেই দিন এখন শেষ। আর এটি সম্ভব করেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। দেশের প্রথম স্যাটেলাইটটির মাত্র ২৬ শতাংশ ক্যাপাসিটি বিক্রি করে মাসে ১০ কোটি টাকার বেশি আয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)। যা থেকে বছরে আয় হবে ১২৫ কোটি টাকার বেশি।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, বাকি তিন-চতুর্থাংশ থেকে যদি মাসে মাত্র ১৫ কোটি টাকা আয় করা যায় তাহলে মাত্র নয় বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের জন্য ব্যয় হওয়া সরকারের পুরো খরচের টাকা উঠে আসবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর প্রথম ক্রেতা বাংলাদেশ টেলিভিশন। প্রতিষ্ঠানটি ‘সি’ ব্যান্ড এবং ‘কেইউ’ ব্যান্ড মিলিয়ে ১ দশমিক ৫০ ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়েছে বিসিএসসিএলের কাছ থেকে। এখান থেকে বছরে বিসিএসসিএলের আয় হবে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। এছাড়া ৩১টি বেসরকারি টেলিভিশন ‘সি’ ব্যান্ড থেকে ৫ ট্রান্সপন্ডার এবং ‘কেইউ’ ব্যান্ড থেকে আরো ৪ ট্রান্সপন্ডার ক্যাপাসিটি ভাড়া নিয়েছে। এখান থেকে বিসিএসসিএলের আয় হবে বছরে ৬০ কোটি টাকা।
মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকসহ দুই ডিটিএইচ কোম্পানি ‘আকাশ’ ও ‘বায়ার’-এর কাছে স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথ এবং ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে আয় করছে বিসিএসসিএল। এর পাশাপাশি এডিএন ও স্কয়ারসহ আরো দুটি কোম্পানিও বিসিএসসিএলের কাছ থেকে সেবা নিচ্ছে। এর বাইরে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বছরে তিন কোটি টাকা আয় হবে স্যাটেলাইট কোম্পানিটির। এছাড়া মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও চুক্তি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগামী বছর থেকে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত
মে মাসে ছয়টি টেলিভিশন কোম্পানি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সেবা নেয়া শুরু
করে। অক্টোবরে এসে দেশের সব টেলিভিশন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে বাণিজ্যিক
সেবা নেয়া শুরু করেছে।
জানা গেছে, বর্তমানে টিভি চ্যানেলগুলো চলে ৫ থেকে ৬ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে। প্রতি মেগাহার্টজের জন্য আগে প্রতিটি চ্যানেলকে বিদেশি স্যাটেলাইটকে মাসে ভাড়া দিতে হতো ৪ হাজার ডলার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে সেটি কমিয়ে ২ হাজার ৮১৭ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বছরে গিয়ে ৩ হাজার ৫০০ ডলার ভাড়া নির্ধারণ করেছে বিসিএসসিএল। বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করে টিভি চ্যানেলগুলোকে আগে প্রতি মাসে ১৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হতো। আর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে এখন প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ লাখ টাকা। এর ফলে যেমন টিভি চ্যানেলগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তেমনি দেশের টাকা দেশেই থাকছে।
দেশের একমাত্র স্যাটেলাইটের কাছ থেকে ক্যাপাসিটি কিনতে এরই মধ্যে আলোচনা চলছে নেপালের একটি ডিটিএইচ কোম্পানির। তারা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর পাঁচটি ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিতে চায়। এছাড়া অন্তত চারটি ট্রান্সপন্ডার কেনার জন্য আলোচনা করছে ফিলিপাইনের অপর একটি কোম্পানি।
এ বিষয়ে বিসিএসসিএলের চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ জানান, নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশকে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবার মধ্যে নিয়ে আসাই সবচেয়ে বড় অর্জন। এখন পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, দেশ আর কখনোই টেলিযোগাযোগ সেবার বাইরে থাকবে না।
তিনি বলেন, দেশের বাজারকে প্রাধান্য দিয়েই আমরা পরিকল্পনা সাজাচ্ছি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বুঝে পাওয়ার পর এ পর্যন্ত স্যাটেলাইটটির ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের ২৬ শতাংশ ক্যাপাসিটি বিক্রি করা হয়েছে, যা থেকে বর্তমানে বিসিএসসিএলের মাসে আয় হচ্ছে ১০ কোটি টাকার বেশি। আরো ১০ শতাংশ বিক্রি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এর মধ্যে নেপালের একটি ডিটিএইচ কোম্পানি এবং ফিলিপাইনের অপর একটি কোম্পানি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে ৯টি ট্রান্সপন্ডার কেনার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
শাহজাহান মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর বাকি সক্ষমতা বিক্রি করে আরো তিনশ’ কোটি টাকা আয় করার সুযোগ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে দেশের দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট সেবা
পৌঁছে দেয়া হচ্ছে জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান,
এরই মধ্যে সরকার দেশের প্রায় চার হাজারেরও বেশি ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড
ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছে। এর বাইরে ৪০টি দ্বীপ, চরাঞ্চলসহ দুর্গম এলাকায়
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া অধুনালুপ্ত ছিটমহলসহ ৭৭২টি দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া
হচ্ছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের প্রসার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে দেশে মাত্র আট লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত, যা বর্তমানে প্রায় ১০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। তখন মোট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করা হতো মাত্র সাড়ে সাত জিবিপিএস যা বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে এক হাজার ২৫০ জিবিপিএস।
এদিকে প্রথম স্যাটেলাইট পাঠানোর বছর পার হতেই দ্বিতীয় স্যাটেলাইট নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে সরকার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নামে এ স্যাটেলাইট হচ্ছে হাইব্রিড স্যাটেলাইট। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছাড়াও আরো অনেক কাজে ব্যবহার করা হবে। ২০২৩ সাল নাগাদ এটি উৎক্ষেপণ করতে চায় সরকার। এরই মধ্যে বিসিএসসিএল বঙ্গবন্ধু-২ এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একজন আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্ট নিয়োগ দিতে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর কারিগরি ও আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই, নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে যুক্ত হতে চায় রাশিয়া। সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে বৈঠক করে এই আগ্রহের কথা জানান রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার আই ইগনাতভ। বৈঠকে রাশিয়ার স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গ্লাভকসমসের পাঁচ সিনিয়র কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে বিসিএসসিএল’র চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ অবশ্যই একটি হাইব্রিড স্যাটেলাইট হবে। তবে কনসালট্যান্টের কাছ থেকে মতামত পাওয়ার পরই এটি চূড়ান্ত করা হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ চারটি অবস্থানে ন্যাশনাল অরবিটাল স্লটের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাছে আবেদন জানিয়েছে। দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের জন্য স্পেসে স্লট চারটি হচ্ছে ৬৯ই, ৭৪ই, ১০২ই এবং ১৩৩ই। এই স্লটগুলো শুধুমাত্র দেশে কভারেজ দেবে। এর আগে রাশিয়ান কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিক-এর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর জন্য বাংলাদেশ ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ লিজ নিয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ১১ মে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হতে বাংলাদেশের খরচ হয় দুই হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে যেসব সেবা পাওয়া যাচ্ছে-
ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম): স্যাটেলাইটের ‘কেইউ’ ব্যান্ডের মাধ্যমে এরই
মধ্যে ডিটিএইচ কোম্পানি ‘আকাশ’ এই সেবা দেয়া শুরু করেছে। এর ফলে প্রত্যন্ত
অঞ্চলেও ডিজিটাল টিভি ও রেডিও সম্প্রচার পৌঁছে দেয়া যাবে। গ্রাহক ছোট একটা
এন্টেনা দিয়ে এই সেবা নিতে পারবেন।
কমিউনিকেশন ট্র্যাংক: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর ‘সি’ ব্যান্ডের মাধ্যমে এ সেবা দেয়া হবে। এর মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় টেলিকমিউনিকেশন ও মোবাইল কমিউনিকেশন সেবা দেয়া হবে, যার ফলে দেশ কখনো নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হবে না।
ভিডিও সম্প্রচার: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ‘সি’ ব্যান্ডের মাধ্যমে এই সেবা নেয়া যাবে। এ সেবার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাভারেজ এরিয়ার যে কোনো জায়গায় ভিডিও সম্প্রচার করা যাবে। গ্রাহক ছোট থেকে মাঝারি ধরনের এন্টেনার মাধ্যমে এ সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
ব্রডব্যান্ড: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ‘কেইউ’ ব্যান্ডের বিমে এ সেবা পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে যে কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব ইন্টারনেট সুরক্ষিত রেখে ব্যবহার করতে পারবেন।
ভি-স্যাট নেটওয়ার্ক: স্যাটেলাইটের এ সেবার মাধ্যমে যে কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ‘সি’ ব্যান্ডের মাধ্যমে এ সেবা প্রদান করবে।