নিউজ ডেস্ক:
একটি সংগঠন। একটি ইতিহাসের মহাকাব্য। এক এক করে ৭১ বছর পেরিয়ে এলো সেই ঐতিহাসিক সংগঠন। পরতে পরতে ইতিহাস জন্ম দেওয়া সেই সংগঠনটি আজ ৭২ বছরে পা রাখল। বলছি আওয়ামী লীগের কথা। ৭১ বছর আগে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পর্যায়ক্রমে তার দূরদর্শী নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির ঠিকানা। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ভূখন্ড পায় দেশের মানুষ।
নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আজ বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে বসে বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি যখন বিশ্ব দরবারে সমাদৃত তখন রাষ্ট্র ও দল পরিচালনার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাঁধে। মূলত তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ সরকার ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে যাচ্ছে।
এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ দলের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দলের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জনসমাগমপূর্ণ কোনো কর্মসূচি নেয়নি আওয়ামী লীগ। আলোকসজ্জা, পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা ও অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে বিভিন্ন আয়োজন করেছে দলটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন ও বিবর্তনের সাক্ষী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে চলা এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ; কিন্তু স্বাধীনতা এনে দেওয়ার পর বেশিদিন দেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নিতে পারেননি স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন দেশের বুকেই ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়েছে তাকে। এতেই
ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা। এরপরও অনেকবার অপশক্তির ছোবলে রক্তাক্ত হতে হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে। বিভিন্ন সময় ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসী হামলা ছাড়াও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহুবার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে।
একই বছর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্বশূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। তখন দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। চার দশক ধরে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এ সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চার বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ; কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত টানা একযুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে।
২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনেকটা সুসংহত হতে সক্ষম হয়ে জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনে সফলতার পরিচয়ও দিয়েছিল দলটি; কিন্তু এ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে আবারও নতুন সংকটের মুখে পড়ে যায় দলটি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ প্রথম সারির অসংখ্য নেতা গ্রেপ্তার এবং একাংশের সংস্কার তৎপরতায় কিছুটা সংকটে পড়ে দলীয় কার্যক্রম।
সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলেন, একাধারে তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটির এ পর্যন্ত আসতে যেমন নানা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, ঠিক তেমনি আগামীতে পথ চলতে গেলে আরও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ১৯৪৯ থেকে ২০২১ সাল, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দল গোছানো। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঠেকানো, ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখা, দুর্নীতিবাজ ও মাফিয়া চক্রকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া, রাজনৈতিক অঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা আওয়ামী লীগের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
তারা বলেন, আওয়ামী লীগ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। যে কারণে সবাই সুবিধা নিতে চাইবে। তাই এখন কে আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাস করে আর কে সুবিধা নিতে দলে ভিড়েছে তা যাচাই করা কঠিন; কিন্তু সুবিধাভোগী আর অর্থলোভীদের ভিড়ে দুঃসময়ে ত্যাগী নেতাদের ভুলে গেলে এর চরম মূল্য দিতে হবে। পাশাপাশি দরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তৃণমূল থেকে সংগঠনকে গুছিয়ে নিয়ে আসা।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের মহাসড়কে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ২১ ফেব্রম্নয়ারির মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা, সমুদ্রসীমা জয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, স্যাটেলাইটের নিজস্ব মালিকানা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বহু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনসহ সুদূরপ্রসারী সাহসী নেতৃত্ব দানে বিশ্বের কয়েকজন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে শেখ হাসিনা অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ এক প্রত্যয়ী এবং সম্ভাবনাময় দীপ্যমান বাংলাদেশ। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে সাংগঠনিক শক্তি দরকার তা আওয়ামী লীগের আছে। এ শক্তি দিন দিন আরও বাড়বে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি :
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে ১৯৫৫ সালের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধর্ম-বর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক, কারাগার থেকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান আর সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমেদ। ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বেই চার বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে দলটি। শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নতুন ঠিকানা হয়।
এর আগে প্রতিষ্ঠাকালীন অফিস রোজ গার্ডেন এবং পরে ৯১, নবাবপুর রোডে অবস্থিত দলের পুরনো কার্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এখানেই বসতেন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর কিছু দিন পর অস্থায়ীভাবে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে কিছু দিন বসে অফিস করেছেন নেতারা। পরে পুরানা পল্টনে দুটি স্থানে দীর্ঘদিন দলের অফিস ছিল।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- বুধবার সূর্যোদয় ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সব কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৯টায় ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বিকাল ৩টায় ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আলোচনা সভা। সভায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এক বিবৃতিতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দিবসটি পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআই’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে এবং বিশেষ ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হবে।