স্কোয়াড্রন লিডার ( অব) সাদরুল আহমেদ খানঃ
ঈদ মানেই আনন্দ। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই আনন্দে মেতে উঠে, এটাই আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাংলাদেশের আর দশজন সাধারণ মানুষের মত ছিল না। কারণ স্বাধীনতার আগে, জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি জেলহাজতে কাটিয়েছিলেন। ফলে স্বাধীনতার আগে বঙ্গবন্ধুর অনেক ঈদও কেটেছে জেলে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করার সুযোগ তিনি কমই পেয়েছেন। আর বঙ্গবন্ধু বাসায় ঈদ করলে, সেটাই হতো পরিবারের জন্য ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়া। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা থেকে দু-একটি ঈদ (১৯৬৭-১৯৭২) পালনের কথা তুলে ধরছিঃ
১৯৬৭ঃ এ যেন ছিল ঈদের নামে এক ধরণের রসিকতা,বঙ্গবন্ধুকে ঈদ করতে হলো একা একা তাও একদিন আগে। ঢাকা কারাগারে বন্দি থাকার কারণে বঙ্গবন্ধুকে সেবছর পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ১দিন আগে অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি ১৯৬৭ ঈদ-উল-ফিতর পালন করতে হয়েছিল। অথচ সেবার পরের দিন অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি ১৯৬৭ পূর্ববাংলার মানুষ ঈদ উদযাপন করেছিল।‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,
‘১১ তারিখে রেণু ( বঙ্গমাতার ডাক নাম) এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই জানুয়ারি ঈদ। ছেলেমেয়েরা জামা-কাপড় নেবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন কর, চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি? তবে কোনো আঘাতই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছেন।’ ‘বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে।’
বঙ্গবন্ধু ভাবতেন, ‘ বাংলার জনগন সেইদিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাবে, এবং দেশের সত্যিকার নাগরিক হতে পারবে।’ কারণ তিনি ঠিকই জানতেন, পরাধীন থেকে কখনও ঈদের আনন্দ করা যায়না। ঈদ-উল-আযহা ছিল ২২ মার্চ ১৯৬৭। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দি জীবনে ঈদ উদযাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে। বারবার আপনজন বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে।আমি তো একলা থাকি। আমার সাথে কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে থাকতে দেয় না। একাকী কি ঈদ উদযাপন করা যায়?’ যদিও এমন বেদনার মধ্য দিয়েও বঙ্গবন্ধুকে ঈদের দিন পালন করতে হয়েছে।
১৯৬৯ঃ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু ঈদ পালন করতে তাঁর গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর মা সায়েরা খাতুন অসুস্থ ছিলেন। তেত্রিশ মাস একনাগাড়ে কারাবন্দী থাকার কারণে বিগত দু’বছরের ছয়টি ঈদ উৎসবের আনন্দ থেকে তিনি, তাঁর পরিবার ও দেশবাসী বঞ্চিত থেকেছে। অনেকদিন পর বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ফিরে এসেছিল ঈদের আনন্দ। আওয়ামী লীগে লেগেছিল প্রাণের সঞ্চার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ এর নিবাচনের পথ সুগম হয়।
১৯৭১ঃ এবছরও ব্যতিক্রম হয়নি বঙ্গবন্ধু কারাগারে, তবে এবার পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুরের কারাগারে। এ বছরের ২০ নভেম্বর ঈদ-উল- ফিতর পালিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই ২০ নভেম্বরের সেই ঈদ ছিল তাঁর জন্য অসহনীয় কষ্টের। কারণ, যে কোনো মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হতে পারে। সেদিন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মৃত্যুদন্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দির অন্তিম ইচ্ছাপূরণের মতো জেলার আমাকে কিছু ফল পাঠিয়েছিলেন। ঈদের নামে এটা এক ধরণের রসিকতাও হতে পারে। কিন্তু আমার আবারও মনে পড়ে গেল দেশে আমার জনগণের কথা এবং বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো আমার হৃদয়। মনে পড়লো ২৫ মার্চ রাতের নিষ্ঠুর দৃশ্য, যখন বলপূর্বক আমাকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া হলো বাংলাদেশ থেকে এবং অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হলো। আমার প্রিয় জনগণ কীভাবে তাদের ঈদ উৎসব পালন করছে? এই প্রশ্ন আমি করলাম, জানি না কাকে! সেই দিন, আবার কখনো তাদের দেখা পাবো কি না সেটা না জেনেই, আমি মোনাজাত করে আমার জনগণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা দয়াময় আল্লাহতালার হাতে সমর্পণ করলাম। এটাই ছিল আমার ঈদ।’
ইনিই হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ফাসিকাস্টে দাড়িয়েও তিনি তাঁর জাতির কথা ভাবতেন, ভাবতেন তাঁর জনগণ কীভাবে ঈদ করছে, সেজন্যই তিনি জাতির পিতা।
১৯৭২ঃ স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ঈদ। বাংলাদেশে তখন লাল সবুজের পতাকা উড়ছে। বাঙালিরা ভেঙে ফেলেছে শত বছরের বন্দীশালা। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশ গড়ার কাজ চলছে তাই পুরোদমে। তাই ১৯৭২ সালের ঈদ ভিন্ন মাত্রার। বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির মাঠে নামাজ পড়লেন। কোনো প্রটোকল রাখলেন না। জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধুর ঈদের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত মানুষজন তাঁর সাথে কোলাকুলির মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিবেশীদের সাথে ঈদ-আনন্দ ভাগ করে নিতেই বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন।
প্রিয় পাঠক, কদিন পরই আমরা ঈদ-উল- ফিতর পালন করবো। আসুন আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ভাসিত হই। উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ। বঙ্গবন্ধু কেবল জনগণকে আত্মত্যাগ করতে বলেননি, তিনি নিজেও সারাজীবন আত্মত্যাগ করে গেছেন।এবার কভিড-১৯ এর বাস্তবতায় আমাদের কে চিরাচরিত ঈদ মিলনী ও গণ জমায়েত ত্যাগ করতে হবে। সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আসুন আমরা ঘরে থাকি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। বাঙ্গালী বীরের জাতী, স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা জয় লাভ করেছি। করোনা ভাইরাস মোকাবেলা একটা যুদ্ধ, এ যুদ্ধেও আমাদের জয় হবেই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ।
লেখকঃ সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-এট-আর্মস; সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ