- গবেষক দলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ৬ বছরে মিলল সাফল্য
- ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি
- শীঘ্রই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর আভাস
নিউজ ডেস্ক:
হারিয়ে যাওয়া মসলিন আবার ১৭০ বছর পর ফিরে এসেছে। একদল গবেষক দীর্ঘ ছয় বছরের আপ্রাণ চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ আবার প্রবেশ করতে যাচ্ছে মসলিনের নতুন যুগে। ১৭১০ সালে বোনা একটি শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু মসলিন শাড়ি বুনেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। যার একটি উপহার দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।
ফলে ঢাকাই মসলিন এখন বাংলাদেশেরই। গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় মিলেছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতিও। একমাস আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং মসলিনকে তুলনা করেছিলেন ভোরের হালকা কুয়াশার সঙ্গে। এ কাপড় নাকি এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে আংটির ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারত। অনায়াসে এঁটে যেতে পারত দেশলাই বাক্সের ভেতর। নারায়ণগঞ্জের দু’জন তাঁতিও যে মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন তাও অনায়াসে আংটির ভেতর দিয়ে পার করা সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও একদল নিষ্ঠাবান গবেষকের হাত ধরে ১৭০ বছর পর ফিরে এসেছে ঢাকাই মসলিন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরই ঢাকায় মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেনকে।
ফুটি কার্পাসের খোঁজে ॥ ৬ বছরের প্রচেষ্টায় ধরা দেয়া সাফল্যের গল্প জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’-এর কথা জানতে পারি। পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে এই গাছের চাষ হতো। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই হয়ত কোন তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের হাতে কোন মসলিন কাপড়, ফুটি কার্পাস কোনটাই ছিল না। ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে খোঁজখবর নিয়েছি। এরমধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে এক ছাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানায়, কাপাসিয়ায় এই তুলার চাষ হতো। গাছের খোঁজে সে এলাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাতে চিঠি পাঠানো হয়, মাইকিং করা হয়। পরে সেখানে নয়টি তুলা গাছ পাই। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৮ প্রজাতির তুলা গাছের সন্ধান পাই। কিন্তু কাপাসিয়া স্থায়ী এক ব্যক্তি গাছটির সঠিক সন্ধান দেন। সংগ্রহ করা গাছ রাবির গবেষণা মাঠে চাষ শুরু করি। স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খুঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আট টুকরো কাপড়ও সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোর কোনটি মসলিন ছিল না। পরে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যাই। কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া হয়। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়।
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনজুর হোসেন বলেন, কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার আঁশ বেশি শক্ত, সাদা ধবধবে। এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে এমন ধারণা ছিল। তারপর লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটা ফুটি কার্পাস। মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০-৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে ৬ জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে সুতা নিয়ে তাঁতির দুয়ারে হাজির হলাম। নারায়ণগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ পেলাম। কিন্তু এত মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিল না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করে। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেয়া হয়েছে।
একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ কদর পেত আমাদের দেশের তাঁতিদের হাতে বোনা এই কাপড়। যা ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পেয়েছিল। ১৮৫০ সালে শেষবারের মতো মসলিনের প্রদর্শনী হয় লন্ডনে। সেই প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর ২০২০ সালে আবার ঢাকাই তাঁতিরাই বুনেছেন এই মিহি সুতিবস্ত্র। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই মসলিন। আর ছয় বছর চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সফল হয়েছেন গবেষকরা। প্রচলিত আছে, কারিগরদের আঙুল কেটে দেয়ার পরে ঢাকাই মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভারতেও এক রকম মসলিন তৈরি হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাই মসলিনের বিশেষত্বই আলাদা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ আয়ুব আলী।
মসলিনের উপাদান সংগ্রহের গল্প ॥ কত কাঠখড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে মিহি মসলিনের উপাদানগুলো, সেগুলো একেকটি আসলেই গল্প। কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোন নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল, যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। সেই গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মসলিন কাপড়ের প্রয়োজন ছিল। এই দুটি জিনিস জোগাড় করাই এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।
প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক মনজুর হোসেন জানান, মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল তার দলটির প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোন মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোন চিহ্নও। ছিল শুধু সুইডিশ গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’ এর মতো কিছু বই। এর মধ্যে ক্যারোলাস লিনিয়াসের বইতে মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’ উপযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে।
ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বিটিভিতে প্রচার করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙ্গামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়।
একইভাবে স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন কাপড় সংগ্রহ করার জন্য ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর তারা প্রায় দুই হাজার ফোন পান। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮ কাপড়ের নমুনা পাওয়া যায়। গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরনো সিল্কের কাপড়।
দেশের অন্য কোন উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তারা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরণা দেন। গবেষকদের দরকার ছিল চার বাই চার ইঞ্চির এক টুকরো ঢাকাই মসলিন কাপড়। কিন্তু কিছুতেই তাদের নমুনা দিচ্ছিল না জাদুঘর। এমনকি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি। গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তারা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে-সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না।
গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরনো সিল্কের কাপড়। ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের জুলাইয়ে কমিটির তিন সদস্যসহ চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত তারা পেয়ে যান।
লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাদের কাক্সিক্ষত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। কাপাসিয়ার আবদুল আজিজ এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেয়া হয়।
এত কিছু করার পরে অবশ্য জাতীয় জাদুঘরে তাদের ঢুকতে দেয়া হয়। প্রকল্প পরিচালক জানান, তারা দেখেছেন, জাদুঘরের শুধু একটি পাগড়ি ঢাকাই মসলিনের তৈরি।
মসলিন শাড়ি তৈরি করতে হলে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন। এক কিলোমিটার সুতাকে ওজন করলে যত গ্রাম হয়, তা দিয়ে সুতার দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে কাউন্ট পাওয়া যায়। যেমন ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সুতার ওজন যদি ২ গ্রাম হয়, তাহলে ২ দিয়ে ১০০০ মিটারকে ভাগ করলে ভাগফল হয় ৫০০। এই ভাগফলকেই কাউন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত ৫০০ কাউন্ট সুতা দিয়ে মসলিন কাপড় বোনা হতো। একটি শাড়িতে ১৪০ থেকে ১৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন পড়ে। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষিত সুতা কাটুনিরা এখন পাঁচদিনে এক গ্রাম সুতা কাটতে পারেন। অর্থাৎ এই গতিতে একজন যদি মসলিনের সুতা কাটতে থাকেন, তাহলে একটি শাড়ি জন্য সুতা তৈরি করতে তার প্রায় দুই বছর লাগার কথা।
কার্পাস তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। সুতা তৈরির কাজের নেতৃত্ব দেন কমিটির সদস্য সচিব ও তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মঞ্জুরুল ইসলাম। এবার খোঁজ শুরু হয় দেশের কোথায় এখনও তাঁতিরা চরকায় সুতা কাটেন। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনও এই তাঁতিরা রয়েছেন। তারা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপেই আসে না। তা সর্বোচ্চ আট-দশ কাউন্টের হতে পারে। তবু গবেষকেরা সেখানেই ছুটে যান। তারা ভাবেন, এমন তো হতে পারে যে তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ মসলিন সুতা কেটেছিলেন। বহুদিন ঘোরাঘুরির পর তারা হাসু ও নূরজাহান নামের অশীতিপর দুই বৃদ্ধার সন্ধান পান। তারা বলতে পেরেছেন তাদের পূর্বপুরুষেরা মসলিন সুতা কাটতেন। তাদেরও ছোটবেলায় মিহি সুতার স্মৃতি রয়েছে। তাদের পেয়ে গবেষক দল যেন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আশার আলো দেখেন। কিন্তু তারা তো এখন সুতা কাটতে পারেন না।
শেষ পর্যন্ত তারা খদ্দরের মোটা সুতাকাটুনিদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের পাঁচজন করে আটটি দলে ভাগ করেন। প্রতিটি দলের মধ্যে সুতা চিকন করার প্রতিযোগিতা করা হয়। প্রতিটি দলের সেরাদের নিয়ে আবার দল গঠন করা হয়। এভাবে ছয়জন সেরা সুতাকাটুনি বের করতেই তাদের দুই বছর সময় লেগে যায়। এই ছয়জনই প্রশিক্ষক হয়ে গেছেন। তাদের একজনকে দিয়ে আরও ১১ জনকে শেখাতে সময় লেগেছে মাত্র ছয় মাস। এ রকম ১০০ জন তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছেন।
আর নতুন করে এই সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করেন তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আলীমুজ্জামান।
লেগে থাকাতেই সফলতা ॥ সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়। তিনটি আঙুলকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করে রাখতে হয়। প্রথমে তাদের আঙুলগুলো শক্ত ছিল। অনুভূতি ছিল না। পরে তাদের আঙুলের ‘ট্রিটমেন্ট’ করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় তিনটি আঙুলে লোশন মাখিয়ে রেখে সকালে সুতা কাটা হতো। আর সব সময় আঙুল তিনটির যত্ন নিতে হয়েছে। যাতে এই তিন আঙুলে কোন আঁচড় না লাগে বা এই তিনটি আঙুল দিয়ে অন্য কোন জিনিস কাটাকুটির কাজ ওরা না করে।
আবার কখনও কাজ করতে গেলে আঙুল ঘেমে যেত, তখন আবার পাউডার দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর চারকার এক ফাঁকে তারা কতটুকু সুতা ছাড়বেন, এ ব্যাপারে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একাগ্রতা তৈরি করা হয়েছে। তাদের মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এটা বড় একটা ব্যাপার। কারণ, এর যান্ত্রিক কোন মাপ নেই। সম্পূর্ণ মনোযোগের মাধ্যমেই চরকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সুতা ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন বলেন, ‘একটা ভরসা ছিল যে আমাদের দেশে জামদানি তৈরি হয়। জামদানিতে ১৫০ কাউন্টের সুতা লাগে। জামদানি আসলে নিম্নমানের মসলিন। এ জন্য আশাবাদী হয়েছিলাম কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ৩০০ কাউন্টের সুতা নিয়ে তাঁতিদের দুয়ারে দুয়ারে আমরা ঘুরেছি। তারা বলেছেন, এটা সম্ভব নয়। খামাখা এগুলো নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। একপর্যায়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে সেই কাক্সিক্ষত তাঁতিকে পেয়ে যাই। তারা হচ্ছেন রুবেল মিয়া ও মোঃ ইব্রাহিম।’
চিকন সুতা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ঘর্ষণ থেকে ক্ষয় রোধের জন্য মাড় দেয়া প্রয়োজন, কিন্তু গতানুগতিক মাড়ে কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তারা চিকন ধানের খইয়ে মাড় ব্যবহার করে কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার মাড় দিয়ে নাটাইয়ে জড়াতে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে যায়। কীভাবে করলে ছিঁড়বে না। সেটাও বের করা হলো। শুকানো হলো। ববিনে ভরতে গেলেও বারবার ছিঁড়ে যায়। প্রতিটি পদক্ষেপই নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়েছে। টানা তৈরি করতে গিয়েও একই অবস্থা।
বিমের মধ্যে সহজভাবে যাতে ববিন ঘুরতে পারে, এ জন্য কাঠামোগত দিকটা ঠিক করে নিতে হয়। এই চিকন সুতা দিয়ে বিমে জড়ানো ও সানা করতে হয়েছে। চিকন সুতার কারণে আঙুলে লেগেই সুতা ছিঁড়ে যায়। আধা ঘণ্টার কাজ চার ঘণ্টা ধরে করতে হয়েছে। বেশি শীতেও হয় না বেশি গরমেও হয় না। মাটির গর্তে তাঁত বসিয়ে করা হয়। মাটির আর্দ্রতার সঙ্গে মসলিনের একটা সম্পর্ক আছে। সুতা বারবার ছিঁড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য বালতিতে পানি রেখেও কাজ করতে হয়েছে।
আবার এই দুই তাঁতিকে কাপড় বোনাতেও ধাপে ধাপে অনেক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। প্রথমে একটি তাঁত করা হয়েছিল। পরে তিনটি করা হয়েছে। এই তাঁতেই রুবেল ও ইব্রাহিম ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন।
লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ’ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে। সেখানেই রয়েছে ১৭১০ সালে বোনা সেই শাড়িটি। সেই শাড়ির নক্সা দেখেই হুবহু ঢাকাই মসলিন তৈরি করেছেন দুই কারিগর।
প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতোমধ্যে তারা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাড়ি দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
প্রকল্পের আরেকজন গবেষক অধ্যাপক ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের ৫টি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে করে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। তারা আশা করছেন, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে খুব শীঘ্রই দেশে মসলিনের ব্যাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে করে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে।
প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলীও আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে।
প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন বলেন, এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। ছয় বছরে ব্যাপক ঘোরাঘুরি, কলকাতা-লন্ডন করেও খরচ হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ বরাদ্দের ৩০ শতাংশ খরচ হয়েছে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেয়া হয়েছে।
মসলিন শব্দের উৎপত্তি ॥ আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’ থেকে জানা যায়, ইরাকের ব্যবসাকেন্দ্র মসুল থেকে ‘মসলিন’ শব্দটি এসেছে। মসুলের সূক্ষ্ম কাপড়কে ইউরোপীয় বণিকেরা বলতেন ‘মসুলি’। সেখান থেকে ‘মসুলিন’, ‘মসলিন’। পরে ঢাকার আরও সূক্ষ্ম কাপড়ও হয়ে যায় মসলিন। বাংলার সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাপড়কে ‘মলবুল খাস’ বা ‘মলমল খাস’ বলা হতো। ধারণা করা হয়, এটিই মসলিন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এবং নবম শতকে সোলায়মানের সিলসিলাত-উত-তাওয়ারিখ-এ মসলিনের উল্লেখ আছে। চৌদ্দ শতকে ইবনে বতুতা, পনেরো শতকে চীনা লেখকেরাও লিখে গেছেন এর কথা। মধ্যপ্রাচ্যের অটোমান সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য আর ভারতীয় রাজপরিবারে এর কদর ছিল বেশ। ফরাসী সম্রাজ্ঞী জোসেফিনের কাছেই ছিল প্রায় শ’ খানেক মসলিন।
উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে বন্ধ হয়ে যায় মসলিন তৈরি। কারণ, পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়, ইউরোপের শিল্প বিপ্লব। ম্যানচেস্টারের সস্তা কাপড় এসে হারিয়ে দেয় দামী মসলিনকে। ১৭০ বছর পরে বাংলাদেশে আবার বোনা হলো সেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন কাপড়ের শাড়ি। ঠিক সে রকমই, যেমনটি বলা হতো, আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় আস্ত একটি শাড়ি।
মসলিন পুনরুদ্ধারের নায়কেরা ॥ প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন। আর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ আয়ুব আলী।
কমিটির অন্য সদস্য হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ আলীমুজ্জামান, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত পরিচালক মোঃ আখতারুজ্জামান, বিটিএমসি ঢাকার মহাব্যবস্থাপক মাহবুব-উল-আলম, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপ-মহাব্যবস্থাপক এ এস এম গোলাম মোস্তফা ও সদস্য সচিব করা হয় তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মোঃ মঞ্জুরুল ইসলামকে। পরে গবেষণাকাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে যুক্ত করা হয়। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুলবন ওসমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম ফিরোজ আলম, এ্যাগ্রোনমি এ্যান্ড এ্যাগ্রিল বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ আইয়ুব আলী ও বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রাজশাহীর গবেষণা কর্মকর্তা মোঃ আবদুল আলিম।