নিজস্ব প্রতিবেদক:
আসন্ন শীত মৌসুমে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় সংক্রমণ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এতে আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রয়োজনে বন্ধ সব কোভিড হাসপাতাল এবং ইউনিটগুলো স্বল্প সময়ে মধ্যে চালু করা হবে।
এজন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সব ধরনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া ঝুঁকি এড়াতে শীত মৌসুমে দেশে বিয়ে, পিকনিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান সীমিত পরিসরে করার বিষয়টি ব্যাপক প্রচারের পক্ষে সবাই মত দেন।
ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলে সেটি সংরক্ষণ ও সরবরাহে সমস্যা হবে না। সেই প্রস্তুতিও সরকারের রয়েছে। শনিবার রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ সভায় এসব বিষয় নিশ্চিত করা হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক বিশেষজ্ঞ যুগান্তরকে বলেন, সভায় দুটি বিষয়ের ওপর সবাই গুরুত্বারোপ করেন। একটি ভ্যাকসিন এবং অপরটি দ্বিতীয় সংক্রমণ। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।
তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য খাতের সবাই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। মূলত আমাদের দেশে শীতকালে ফ্লুর প্রকোপ বাড়ে। ফলে এই সময়ে মানুষের সর্দি-কাশি বেশি হয়।
তাছাড়া যাদের শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে তারও এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই এই বিষয়ে নজর দিতে অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাতে এসব রোগীর কোভিড-১৯ হিসাবে চিহ্নিত করা না হয়।
একই সঙ্গে বলা হয়, যাতে এ ধরনের রোগীর চিকিৎসায় কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। যেহেতু এই রোগগুলোর সঙ্গে শ্বাসযন্ত্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে আর কোভিড-১৯ এর সঙ্গেও শ্বাসযন্ত্রের নিবিড় সম্পৃক্ততা রয়েছে।
মূলত এদিক বিবেচনায় নিয়েই দেশে দ্বিতীয় সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ সময় কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করে বলেন, নন-কোভিড সার্ভিস দেয়ার জন্য সব হাসপাতাল খুলে দেয়া ঠিক হয়নি। পরে রোগী বাড়লে সমস্যা হতে পারে।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লা বলেন, আমরা করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণের শেষ ধাপে আছি। সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল ফয়েজ বলেন, করোনা সম্পর্কিত সব তথ্য জনগণকে জানাতে হবে।
যাতে জনগণের মধ্যে কোনো ভুল তথ্য না থাকে। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর কার্যক্রম বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
বিএমএ মহাসচিব কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় কর্মরত চিকিৎসকদের থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ভ্যাকসিন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, সময়মতো ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে যেমন যোগাযোগ করা হচ্ছে, তেমনি সেগুলো সংরক্ষণের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
আমাদের হয়তো তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। এছাড়া ভ্যাকসিন যেন ওষুধের দোকানে বিক্রি না হয়, সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে বলা হয়।
সভায় দ্বিতীয় সংক্রমণের প্রস্তুতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম মন্ত্রীসহ সবাইকে অবগত করেন। তিনি জানান, সব ধরনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে।
ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা চলমান রয়েছে। রোগী কমে যাওয়ায় যে হাসপাতালগুলোর কোভিড ইউনিট বন্ধ করা হয়েছে, স্বল্প সময়ের নোটিশে সেগুলো চালু করার ব্যবস্থা করা আছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেটে দু’শ শয্যার কোভিড ইউনিট সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে বলেও জানান তিনি।
ভ্যাকসিন বিষয়ে তিনি বলেন, ভ্যাকসিন সংরক্ষণের এবং পরিবহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে। বর্তমানে হামের টিকা হিমাঙ্কের নিচে (২০) ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করা আছে।
সেগুলো উপযুক্ত কোল্ড চেইন মেনেই সারা দেশে পরিবহন করা হয়। তিনি বলেন, আরএনএ ভ্যাকসিনগুলো ছাড়া সব ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে।
মাইনাস ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ভ্যাকসিন সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ আছে, যেটি আমরা ব্যবহার করে থাকি।
তাছাড়া কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে শুধু অত্যাধুনিক আরএনএ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিতগুলোর ক্ষেত্রেই মাইনাস ৬০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করতে হয়। সে বিষয়েও দাতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
তাই সংরক্ষণ ও পরিবহন নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলেও সবাইকে জানান তিনি। আর ভ্যাকসিন কোনো ওষুধের দোকানে বিক্রি হবে না জানিয়ে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেন, ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।
এ সময় অধিদফতরের ইপিআই পরিচালক এ বিষয়ে বিস্তারিত সবাইকে জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে টিকা সংরক্ষণাগারে হামের টিকা আছে। সেগুলো সারা দেশে পাঠানো হলে সংরক্ষণাগার খালি হয়ে যাবে। তখন ভ্যাকসিন রাখতে কোনো সমস্যা হবে না।
মহাপরিচালকের বক্তব্যের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে নির্দেশ দেন।
পাশাপাশি শীত মৌসুমে আমাদের দেশে বিয়ে, পিকনিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি বেশি হয়। এবারের সংক্রমণ এড়াতে এসব অনুষ্ঠান সীমিত পরিসরে করতে সবার প্রতি আহবান জানান।
এছাড়া ভ্যাকসিনের বিষয়ে তিনি বলেন, যথাসময়ে ভ্যাকসিন পেতে একাধিক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশেও ভ্যাকসিন আসবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন তিনি।
এ সভার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে শনিবার রাতে আমরা সভা করেছি।
সেখানে ভ্যাকসিন ও দ্বিতীয় সংক্রমণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু বিষয়েও আলোচনা হয়।
সভার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, সব হয়েছে। তবে এ বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এর আগে ২৮ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় আসছে শীতে দেশে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ আসবে কিনা, এলে করণীয় কি সে বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় সংক্রমণের জন্য এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন।
এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে কন্টাক ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি পরামর্শক কমিটি সর্বস্তরে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মানতে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেন।
এছাড়া ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম এই অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর
বক্তৃতায় কোভিড-১৯ নির্মূলে বিশ্ববাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার আবশ্যকতা, ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত ও দুর্দশা লাঘবে আমাদের গৃহীত কার্যক্রম বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন।
শনিবার অনুষ্ঠিত এ সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সামগ্রিক বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন মন্ত্রী।
এই আলোচনায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য শিক্ষার মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন, সাবেক দু’জন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মুনির, অধ্যাপক ডা. আবুল ফয়েজ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান, মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. শাহিদুল্লা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও অংশ নেন।