নিউজ ডেস্ক:
বুধবার বেলা ১১টা বেজে ২০ মিনিট। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ভবনে নিজের চেম্বারে (রুম নম্বর ৩০১) বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে টেবিলে রাখা স্মার্টফোনে কিছু একটা দেখছিলেন সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী। কথাও বলছিলেন। হঠাৎ দেখলে যে কেউ ভাববে হয়তো ভিডিওকলে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। কিন্তু মোমতাজ উদ্দিন মেহেদী জানালেন, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাই কোর্ট বেঞ্চে একটি জামিন আবেদনের শুনানি করছিলেন তিনি।
শুধু মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী একা নন, গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন রুম ঘুরে আইনজীবীদের ভার্চুয়াল শুনানিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। অনেক আইনজীবী নিজের বাসা থেকেও ভার্চুয়াল শুনানিতে যুক্ত হচ্ছেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় বদলে যাওয়া বাস্তবতায় দেশের লাখো বিচারপ্রার্থী মানুষ এই ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমেই পেয়েছেন ন্যায়বিচার। এখন মামলা দায়ের থেকে শুনানি সবই হচ্ছে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। আদেশ বা রায়ের অনুলিপিও পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। এতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমেছে বলে মনে করেন আইনজীবীরা।
করোনাকালে যখন দেশের সব অফিস বন্ধ, তখনো চলেছে আদালতের কার্যক্রম। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় ভার্চুয়ালি সচল রাখা গেছে বিচার বিভাগ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের একাধিক বিচারপতি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিম্ন আদালতের বিচারক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কয়েক শ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হলেও সচল রয়েছে বিচার কার্যক্রম। সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে ৩ লাখ ১৫ হাজারের বেশি জামিন আবেদন নিষ্পত্তি করে সারা দেশের আদালতগুলো।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১১ মে থেকে গত ১০ আগস্ট পর্যন্ত দুই ধাপে শুধু অধস্তন আদালতেই ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৮টি মামলায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৬৭ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। জামিন আদেশের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কারাগার থেকে মুক্তিও পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২০২০ সালের ১১ মে থেকে ওই বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৫৮ কার্যদিবসে ভার্চুয়াল শুনানি নিয়ে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৯টি মামলায় ৭২ হাজার ২২৯ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয় দফায় গত ১২ এপ্রিল থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ৬৮ হাজার ২১৯টি মামলায় ৮৮ হাজার ৫৩৮ জনকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময়ে দুই হাজার ২৬১ শিশুকেও জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। গত বছর দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ প্রবেশ করে ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থায়। এ লক্ষ্যে গত বছর ৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ-২০২০’ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তার দুই দিন পর ৯ মে ভার্চুয়াল উপস্থিতিকে সশরীরে উপস্থিতি হিসেবে গণ্য করে অধ্যাদেশটি জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপর গত বছরের ১০ মে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে ১১ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে দেশে ভার্চুয়াল আদালতের দুয়ার খুলে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। পরে এ অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করে সরকার। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, করোনার সময়ে যখন সবকিছু বন্ধ, তখনো আমাদের বিচার বিভাগ সচল ছিল। এই সময়ের মধ্যেই সরকার ভার্চুয়াল আদালতের জন্য আইন করেছে। আদালত সচল থাকায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও অনেক কমেছে। তিনি বলেন, এখন আর আইনজীবীদের আদালতে আসতে হয় না। গ্রামে বা বিদেশে বসেও তারা মামলার শুনানি করতে পারেন। বিচারপ্রার্থীরাও যে কোনো স্থান থেকে ভার্চুয়াল আদালতে যুক্ত থেকে নিজের মামলার শুনানি দেখতে ও শুনতে পারছেন। এটা বিচার বিভাগের জন্য এক অনন্য ইতিহাস।
জানতে চাইলে ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাকালে হঠাৎ করেই আমরা ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছি। প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর চেষ্টার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, যে কোনো দুর্যোগে বিচার বিভাগ বন্ধ থাকতে পারে না। করোনার মতো মহামারীতেও আমাদের আদালত বন্ধ রাখতে হয়নি। এতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমেছে।
মোবাইল–ল্যাপটপের স্ক্রিনে উন্মুক্ত আদালত : বিচারক-আইনজীবী কিংবা বিচারপ্রার্থীকে করোনার ঝুঁকি নিয়ে যেতে হয়নি জনাকীর্ণ আদালতগুলোতে। সুবিধাজনক স্থানে থেকেই মোবাইল কিংবা ল্যাপটপে ‘জুম’ অ্যাপের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারছেন ভার্চুয়াল আদালতে। এক্ষেত্রে অডিও-ভিডিও সংযুক্ত এক একটি মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনই হয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের জন্য উন্মুক্ত আদালত। আবার আদালতের দেওয়া রায় বা আদেশের সংক্ষিপ্ত ফলাফল মুহুর্তেই প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে। মামলা সংশ্লিষ্টরা নিজ নিজ স্থান থেকেই জেনে নিতে পারছেন তার মামলার সর্বশেষ অবস্থা বা ফলাফল।
রিমান্ড শুনানি : করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত উ™ভূত পরিস্থিতিতে বিচারক ও আইনজীবীদের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে যখন আদালত চলছে তখন আসামির আদালতে উপস্থিতি কীভাবে নিশ্চিত হবে? এমন প্রশ্নের সমাধানও খুঁজতে হয়েছে দেশের বিচার বিভাগকে। আর এক্ষেত্রেও ভরসা হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম। দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে কারাগার থেকে হাজতি আসামিদের আদালতে হাজির করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এমন বাস্তবতায় প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কারাগারে থাকা আসামির রিমান্ড শুনানি এবং হাজতি আসামিকে আদালত কক্ষে হাজির না করে কারাগারে রেখেই জামিন শুনানির ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বিচারিক কার্যক্রমের অনন্য এক উদাহরণ তৈরি হয়।
ইংরেজিতে লেখা রায় হচ্ছে বাংলায় : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে আদালতের আদেশ ও রায় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার চালু করেছে সুপ্রিম কোর্ট। মামলার পক্ষ এবং জনসাধারণের বোঝার সুবিধার্থে ইংরেজিতে লেখা রায় বাংলায় অনুবাদের এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।