সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার ও গুজবের একটি দৃষ্টান্ত এ রকম- ‘অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা আপাকে, ১৭টি আদেশ জারি করেছেন- ব্যাংক, এনজিওর ছয় মাসের লোনের কিস্তি স্থগিত। গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল তিন মাস স্থগিত। আগামী দুই মাসের বাড়িভাড়া মওকুফের জন্য সকল বাড়িওয়ালাকে আদেশ। এক লক্ষ দিনমজুরের এক মাসের খাবার দ্রব্যাদি দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে। দেশের মানুষের স্বার্থে নববর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল এবং সেই টাকায় করোনা রোগীদের জন্য সরঞ্জাম ক্রয় করতে আদেশ। স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা। সকল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মচারীদের এক মাসের ছুটি এবং বেতন দেয়ার আদেশ। এছাড়াও করোনা মোকাবিলার জন্য ১০০ কোটি থেকে এখন ৫০০০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ৩ এপ্রিল সব আদেশ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে বের হবে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।’
এই অপপ্রচার এবং গুজব সম্পর্কে ২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে (যা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত)- বাড়িভাড়া মওকুফ, ব্যাংক লোন ও বিদ্যুৎ বিল তিন মাসের জন্য স্থগিত, সব অফিসে এক মাসের ছুটি সংক্রান্ত যে গুজবটি ফেসবুকে ভাইরাল করা হচ্ছে তা পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার গৃহীত পদক্ষেপ নিজেই অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানাবেন বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এ জন্য যারা অপপ্রচারে লিপ্ত তাদের মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে জাতিকে ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানেও ফেসবুক কিংবা অনলাইনে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো- ১. করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ২. লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। ৩. পিপিই সাধারণভাবে সকলের পরার দরকার নেই। চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ৪. কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সব চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। ৫. যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। ৬. নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। ৭. নদীবেষ্টিত জেলাসমূহ নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে। ৯. পরিচ্ছন্নতা নিশ্চত করা। সারাদেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। ১০. আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগসহ সব সরকারি কর্মকর্তা যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন- এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। ১১. ত্রাণ কাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। ১২. দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। ১৩. সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। ১৪. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন স্থবির না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে। ১৫. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে। ১৬. সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। যাতে বাজার চালু থাকে। ১৭. সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে ১৮. জনস্বার্থে বাংলা নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে যাতে জনসমাগম না হয়। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপন করতে হবে। ১৯. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজের সব স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সবাইকে নিয়ে কাজ করবে। ২০. সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। ২১. জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবেন। ২২. সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন: কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যক্তা/বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ২৩. প্রবীণ নাগরিক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ২৪. দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সব সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ২৫. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ২৬. আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পণ্য ক্রয় করবেন না। খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। ২৭. কৃষকগণ নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। ২৮. সব শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘর পরিষ্কার রাখবেন। ২৯. শিল্প মালিকগণ শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন। ৩০. গণমাধ্যম কর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ৩১. গুজব রটানো বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। গুজবে কান দেবেন না এবং গুজবে বিচলিত হবেন না।
মনে রাখা দরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শেখ হাসিনা সরকার আন্তরিক বলেই, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন মুজিববর্ষের প্রথম দিন ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাইরের দেশ থেকে আসা এয়ারলাইনসের যোগাযোগ মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ক্রমান্বয়ে শূন্যে নেমে এসেছে। যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন তাদের জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাদি সম্পন্ন হয়েছে। ২৫ মার্চ থেকে সেনাবাহিনী মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। ২৬ মার্চ থেকে সকল প্রতিষ্ঠানের ছুটি ঘোষণা করে গৃহে অবস্থানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। ডাক্তারদের পিপিই দেয়া হয়েছে, টেস্ট কিট এসেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন উপজেলা পর্যায় থেকে এক হাজার টেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন। বড় বড় কোম্পানিগুলো সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বসুন্ধরা অস্থায়ী হাসপাতাল বানিয়ে দিচ্ছে, বেক্সিমকো, স্কয়ার, আকিজের মতো বড় বড় কোম্পানি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের উদ্যোগে স্যানিটাইজার তৈরি করে জনগণের কাছে বিলিয়ে দিচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি করোনা দুর্যোগে মাস্ক ও পিপিই তৈরি করে দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রায় ২০টি করোনা-পরীক্ষা কেন্দ্র নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ব্যক্তির করোনা টেস্ট সম্ভব। এভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও বেসরকারি উদ্যোগের মহতী আয়োজনের মধ্যে করোনা প্রতিরোধে গুজবের বার্তা প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। ছুটিতে গৃহে অবস্থান করে সরকারকে সহযোগিতা করাও জরুরি।
কারণ কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই রোগে মৃত্যুহার মাত্র ৫.২৩ শতাংশ। আক্রান্ত হলেই মৃত্যু হবে এ ধরনের ভাবনা ঠিক না। এ জন্য অপপ্রচার ও গুজবে কান না দিয়ে বরং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চললে করোনা-দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব অতীতেও হয়েছে। বিশেষত ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ ভারতে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে এক কোটি সত্তর লক্ষেরও বেশি মানুষের অপমৃত্যু হয়েছিল। সে সময় ব্রিটিশ শাসকরা ১৬৬৫ সালের লন্ডন প্লেগের অভিজ্ঞতার আলোকে এদেশেও কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন করে রোগের সংক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।
তার আগে অবশ্য ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইতালিতে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা প্লেগের মহামারিতে কোয়ারেন্টাইনের প্রচলন করা হয়। সেটি ছিল ৪০ দিনের। ব্রিটিশরা ইউরোপের মহামারি মোকাবিলার পদ্ধতি অনুসরণ করায় উনিশ শতকে সংবাদপত্রও মানুষকে সচেতন করতে ভূমিকা রেখেছিল। ‘কেউ বাইরে বেরোবেন না। ঘরে থাকুন। অন্যজনের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকুন’- এই আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে তখন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হয়েছিল।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান ও তার দেয়া নির্দেশনা পালন করা আমাদের জীবন রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক। এ জন্য তার প্রতিটি নির্দেশনা ও সতর্কতা পালনে মানুষকে বাধ্য করাও দরকার।
লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম
এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।