প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরে প্রত্যাশার চেয়েও অর্জন অনেক বেশি। চীন সফরের সবচেয়ে বড় অর্জনই হচ্ছে দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সঙ্কট ‘দ্বিপক্ষীয় সমাধানে’ বিশ্বের তৃতীয় পরাশক্তি এ দেশটির পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস আদায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় বিশ্বের বড় বড় সকল দেশ ও জোটের নিরঙ্কুশ সমর্থন আদায়ের পর এবার চীনের কাছ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতার আশ্বাস আদায়ের পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে।
বিদ্যুত-পানিসম্পদ-পর্যটনসহ নয়টি খাতে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের আশ্বাস এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতেও কূটনৈতিক সফলতা দেখিয়ে শনিবার দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর চীনে প্রথম পাঁচ দিনের সরকারী সফরে অর্জিত সাফল্যগুলো দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে আগামীকাল সোমবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন সরকারপ্রধান।
২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের গণবাস্তুচ্যুতি ও মানবতার চরম বিপর্যয়ের পর প্রথমবারের মতো চীন সফরের সুযোগে ওই দেশটির নেতাদের কাছে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলোচনার মাধ্যমেই এ সঙ্কট সমাধান করতে বলার পাশাপাশি প্রয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার সময় একমত পোষণ করে স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই সঙ্কট (রোহিঙ্গা) আর ফেলে রাখা যায় না। রোহিঙ্গারা অবশ্যই তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবে।
চীনের অন্য শীর্ষ নেতারাও একমত পোষণ করে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এ সঙ্কটের সমাধান। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ সম্মেলনসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের অকুণ্ঠ সমর্থন আদায়ের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের মিত্র দেশ বলে পরিচিত শক্তিধর দেশ চীনের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস আদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক অর্জন। চীন যদি সত্যিকারেই আন্তরিক হয়, তবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত প্রদানের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক অভিজ্ঞ মহল।
তাদের মতে, শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু নয়, বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে লাভ-ক্ষতির বিচারে অনেকটাই সুবিধানজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। দুই পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও বাড়তি শুল্কের হাত থেকে রক্ষা পেতে চীন থেকে শিল্প-কারখানাও এখন এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসহ আরও কিছু খাতে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। এ অবস্থায় চীন সরকারের পাশাপাশি দেশটির ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ বিনিয়োগ করলে দুদেশই যে লাভবান হবে, তা পাঁচ দিনের সফরে বিভিন্ন ফোরামের বৈঠকে অত্যন্ত সফলভাবে তা তুলে ধরতে সফল হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশে ফেরার আগের দিন শুক্রবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এই মতৈক্য হয়।
বৈঠক শেষে দুই নেতা প্রথমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সম্মত হয়ে বলেন, এটি অমীমাংসিত রাখা যাবে না। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আরও বলেন, এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে। কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হবে এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। রোহিঙ্গারা অবশ্যই নিজ দেশে ফিরে যাবে। বৈঠকে উভয় নেতা উল্লেখ করেন যে, এ ব্যাপারে দুই দেশের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে কাজ করবেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তারা মিয়ানমারের ওপর ‘গুড উইল’ কাজে লাগাবেন।