নিউজ ডেস্ক:
করোনা মহামারিতে অর্থনীতি আর জীবন-জীবিকার স্বার্থে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বড় অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত এই প্রণোদনায় রয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার ২৩টি প্যাকেজ। এখন পর্যন্ত এ থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠান এবং পাঁচ কোটি ৮১ লাখ ব্যক্তি উপকৃত হয়েছেন। এরপরও বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং হতদরিদ্রসহ অর্থনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় এক লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার এই প্যাকেজের অর্থ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা খুব কমই ঋণ সহায়তা পেয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। আর নগদ অর্থ সহায়তার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক তালিকার ৫০ লাখ মানুষের সবাইকে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যায়নি। যে কারণে প্যাকেজের অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আর অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতা রয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারিতে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যই ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। এর অংশ হিসেবে দেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ হয় ২৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা জুন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে। বরাদ্দের প্রায় চার ভাগের একভাগ টাকা পড়ে থাকলেও উদ্যোক্তাদের অনেকে চেয়েও ঋণ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। আর শুরুতে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য নগদ অর্থ বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম আর ত্রম্নটির কারণে শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ পরিবার এ সহায়তা থেকে বাদ পড়ে।
জানা গেছে, ২৩টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকায় এখন পর্যন্ত এক লাখ চার হাজার ৯৯৬টি প্রতিষ্ঠান সুবিধা পেয়েছে। আর পাঁচ কোটি ৮১ লাখ ১৫ হাজার ২১১ জন উপকৃত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্যাকেজ ঘোষণার পর ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট প্রণোদনার মোট বরাদ্দের প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্থই ইতোমধ্যে বিতরণ করেছে।
জানা যায়, আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে, স্বল্প সুদে এ ঋণের সুবিধা বড় শিল্পকারখানা আর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারাই পেয়েছেন এবং উপকৃত হয়েছেন। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী
শত শত কোটি টাকা এই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়েছেন বলেও বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
করোনা প্যাকেজের আওতায় মহামারির শুরুতে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান পোশাক কারাখানার বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এ থেকে ৩৮ লাখ শ্রমিক উপকৃত হয়। যার ৫৩ শতাংশ নারী শ্রমিক এবং তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের শ্রমিকদের সহায়তার জন্য এক হাজার ৫শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যার বাস্তবায়ন সম্প্রতি শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত উপকারভোগীর সংখ্যা ছয় হাজার জন।
ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এ থেকে তিন হাজার ২১২টি প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে। যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। একইভাবে ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ থেকে তিন হাজার ৪০৭টি প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে। এ প্রকল্পটিও বর্তমানে চলমান রয়েছে। এছাড়া এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এক হাজার ৫শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা সম্প্রতি শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইডিএফ ফান্ড সুবিধা বাড়িয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এখান থেকে সুবিধা নিয়েছে ছয় হাজার ৩৫২টি প্রতিষ্ঠান। প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট পুনঃতফসিল প্রকল্পে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আর সুবিধা নিয়েছে ৭১টি প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানি দেওয়া হয়েছে ১শ’ কোটি টাকা। সুবিধাভোগীর সংখ্যা নয় হাজার ৫৭৯ জন। এ প্রকল্প তিনটি চলমান রয়েছে।
মৃতু্যবরণকারী সরকারি কর্মচারীর পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যবীমা এবং জীবন বীমার জন্য ১৩২ জনকে ৭৫০ কোটি টাকার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার। এ থেকে খাদ্য সহায়তাপ্রাপ্ত এক কোটি ২৯ লাখ দরিদ্র পরিবার উপকার পেয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করতে সরকারের খরচ হয়েছে ৭৭০ কোটি টাকা। এর সুবিধাভোগী ৪৯ লাখ। এর মধ্যে শহর এলাকায় কার্ডের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ২১ লাখ ব্যক্তিকে। লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে এক হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্বাচিত দুঃস্থ নাগরিক ৩৫ লাখ, ডেইরি ও পোল্ট্রি খামারি চার লাখ সাত হাজার এবং মৎস্য খামারি ৭৮ হাজার জন। ২য় পর্যায়ে লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে ৯৩০ কোটি টাকা রবাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা থেকে ৩৫ লাখ নির্বাচিত দুঃস্থ নাগরিক, ৯৭ হাজার বোরো চাষি ও নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী সাত হাজার ৫শ’ জন সুবিধা পেয়েছে। করোনায় ভাতা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করে ৮১৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। ফলে নতুন করে পাঁচ লাখ বয়স্ক ভাতা আর তিন লাখ ৫০ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাকে ভাতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই খাতে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে ১৫০টি উপজেলা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এজন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক হাজার ২শ’ কোটি টাকা। আট লাখ বয়স্ক লোক ও চার লাখ ২৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা সুবিধা পেয়েছেন।
গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে দুই হাজার ১৩০ কোটি টাকা। যা থেকে ৬৬ হাজার পরিবার সুবিধা পেয়েছে। কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণ খাতে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ২২০ কোটি টাকা। যা থেকে চার লাখ ৩০ হাজার কৃষক উপকৃত হয়েছে। কৃষি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে নয় হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। ফলে এক কোটি ৬৫ লাখ কৃষক পরিবার সহায়তা পেয়েছে। কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এক লাখ ৭৬ হাজার কৃষক ফার্ম এ থেকে উপকার পেয়েছে। নিম্ন আয়ের পেশাজীবী কৃষক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। যা থেকে দুই লাখ ৬৩ হাজার ব্যবসায়ী সুবিধা পেয়েছে। প্রকল্পটি বর্তমানে চলমান রয়েছে।
কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় (পলস্নী সঞ্চয় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসের স্থগিত ঋণের আংশিক সুদ মওকুফ বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা থেকে ৭২ লাখ ৮০ হাজার ব্যক্তি উপকৃত হয়েছে। আনসার ও ভিডিপি (ব্যাংক এবং পিকেএসএফ) তিন হাজার ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা সম্প্রতি শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সঙ্গীতা আহমেদ জানান, তাদের দশ হাজারের বেশি উদ্যোক্তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন এই প্রণোদনার সুবিধা পেয়েছে। অনেকে ব্যাংকের কাছে চেয়েছে কিন্তু ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই প্রণোদনা প্যাকেজ শেষ। যা তিন-চার মাস আগের ঘটনা। কিন্তু আসলে তা শেষ হয়নি। এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে? আর ঋণ সুবিধা যথাসময়ে না পেলে তা আর ব্যবসায় কোনো কাজে আসে না। ফলে বহু উদ্যোক্তা এরই মধ্যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।