নিউজ ডেস্ক:
কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অনিয়মে জড়িতরা অবসরে গেলেও ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মে জড়িতরা অবসরে গেলেও ছাড় পাবেন না। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন তিনি। একনেক ব্রিফিং এসব তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম।
পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা অনিয়ম করেছে তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। জড়িতদের মধ্যে যারা অবসরে গেছেন, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলেছেন তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী আরো জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু ভেতরে নয় সার্বিকভাবে করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেছেন, কারখানা এলাকায় ইটিপি, সিইটিপি স্থাপন করতে হবে। নদীতে বর্জ্য ফেলা যাবে না। এছাড়া কোনো প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া না গেলে রিজার্ভ থেকেও ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই অর্থ থেকে ঋণ নেয়া যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের সকল এলাকায় সমানভাবে উন্নয়ন কাজ করতে হবে। যাতে কোনো এলাকার মানুষ অভিযোগ করতে না পারে আমরা অবহেলিত। এছাড়া নদী, খাল নিয়মিত ড্রেজিংয়ের নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সোনালী ৭৫ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানানো হয় পরিকল্পনা কমিশনের সকলের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘের এসডিজি পুরস্কার পাওয়ার জন্যও অভিনন্দন জানানো হয়। একই সঙ্গে আমরা বলেছি আমরা রাজনীতিবিদ ও আমলারা সবাই মিলে আপনার উন্নয়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাব। আমরা আবারও তার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে বলেছি আমরা আপনার পেছনে আছি।
এদিকে সভায় কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের সংশোধনী প্রস্তাবসহ ৯ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫৫১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৩ হাজার ৭৪২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, বৈদেশিক ঋণ সহায়তা থেকে ২ হাজার ৭৮২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। গণভবন থেকে একনেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিফ্রিং করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মামুন-আল-রশীদ, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীসহ পরিকল্পনা কমিশনের অন্য সদস্যরা।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, চূড়ান্তভাবে নোটিশ দেয়া হয়েছে যাতে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের কাজ বর্ধিত মেয়াদের মধ্যেই শেষ করা যায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। যারা এই প্রকল্পের বিলম্বের ক্ষেত্রে জড়িত এবং নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন তাদের শাস্তির জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আবারও অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী এর আগে একই সঙ্গে শাস্তিও দিতে বলেছেন, আবার কাজও চলমান রাখতে বলেছেন। যাতে এটি মৃত প্রকল্প না হয়। তিনি বলেন, এতদিন প্রকল্পটি ঝুলে ছিল। স্থানীয়রাও অপেক্ষা করেছিলেন। স্থানীয় যারা রাজনীতি করেন, তারাও প্রকল্প শেষ না হওয়ায় লজ্জায় পড়েছিলেন। আমার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। আজ সংশোধনী প্রস্তাবটি অনুমোদন হওয়ায় আশা করা যাচ্ছে কাজে গতি আসবে।
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ। কর্ণফুলী নদীর নিচে নির্মাণাধীন এই ট্যানেল ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের অগ্রগতি ভালো হওয়ায় অনেক আগেই শেষ হবে। একনেক বৈঠকে এসব তথ্য জানানো হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এর আগে এই টানেলের প্রথম চ্যানেলের মুখ খুলে দেয়া হলেও আগামী শুক্রবার দ্বিতীয় চ্যানেলের মুখ খুলে দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে ট্যানেলের কাজ অনেক দুর এগিয়ে যাবে। তারপর ঘষামাজা করে উদ্বোধনের দিন-তারিখ নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে মোট ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১২ সালের জানুয়ারি হতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য ২০১২ সালের ৬ মার্চ একনেকে অনুমোদিত হয়। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া প্রথম দফায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এরপর মোট ৬১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে এবং বাস্তবায়ন মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ বছর বাড়িয়ে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন করা হয়। এতেও শেষ হয়নি বাস্তবায়ন। ফলে ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটির আন্তঃখাত সমন্বয় করা হয়। কার্যক্রম বিভাগ ২০২০ সালের ২২ জুন প্রকল্পটির মেয়াদ ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছর বৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৭৪২ কোটি টাকা এবং মেয়াদ ২০১২ সালের জানুয়ারি হতে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করে প্রস্তাব পাঠানো হয়। এই প্রস্তাবের ওপর ২০২০ সালের ১২ মার্চ প্রথম প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পুনর্গঠিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) প্রথম পিইসি সভার সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে প্রতিপালন না করায় ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট দ্বিতীয় পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পিইসি সভার সিদ্ধান্তের আলোকে পুনর্গঠিত ডিপিপি চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়। এ সময় এই প্রস্তাব অনুমোদন না করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার কারণ এবং দায়দায়িত্ব নিরুপণ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া এবং ভালোভাবে পরীক্ষা করে প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য যথানিয়মে পুনরায় একনেকে উপস্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়। একনেক সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জানুয়ারি আইএমইডির সচিবকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই প্রতিবেদন পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে স্বাস্থ্য এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হলোÑ সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্প। টাঙ্গাইল-দেলদুয়ার-লাউহাটি-সাটুরিয়া-কাওয়ালীপাড়া-কালামপুর বাসস্ট্যান্ড সড়ক আঞ্চলিক মহাসড়কের যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প। এছাড়া কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ, জগন্নাথপুর ও মোহনগঞ্জ উপজেলায় দু’টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এটিআই) স্থাপন এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার নদীতীর সংরক্ষণ, ছোটনদী, খাল-বিল পুন: খনন ও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প। এছাড়া শরীয়তপুর জেলার কীর্তিনাশা নদীর ডান ও বাম তীর রক্ষা প্রকল্প। বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন স্থাপন এবং খুলনা হতে মংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।