নিউজ ডেস্ক:
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। বিদেশি অনেক সংগঠন বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয়। সেই প্রেক্ষাপটে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড। এর মেয়াদ শেষ হতে না হতেই আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরিবেশ নিরাপদ রাখতে নতুন করে উদ্যোগী হলেন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কর্মরত ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ এর আদলে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড ফর হেলথ অ্যান্ড সেইফটি ইন দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি’ নামে নতুন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে।
এ বিষয়ে দুই বছর মেয়াদি একটি নতুন চুক্তিতে সই করেছে এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক রিটেইল ব্র্যান্ডগুলো। কোম্পানি এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে এই চুক্তির ফলে কারখানার কর্মপরিবেশ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের মত চুক্তিতে থাকা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে।
এই জোট বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তায় কাজ করবে; যেখানে বাংলাদেশে ‘অ্যাকর্ড’ এর কাজের সফলতাকে কাজে লাগানো হবে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে এই নতুন ‘অ্যাকর্ড’ কার্যকর হবে বলে বুধবার বাংলাদেশ অ্যাকর্ডের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
যা বলছেন পোশাক শিল্প মালিকরা
নতুন ‘অ্যাকর্ড’ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বুধবার রাতে নিউজবাংলাকে বলেন, “অ্যাকর্ড থেকে কাল (মঙ্গলবার) আমাকে ফোন করেছিল। তারা বাংলাদেশের অ্যাকর্ডের সফলতার ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি ‘অ্যাকর্ড’ জোটের বিষয়ে চুক্তি করেছে বলে জানায়। তার আগে তাদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি।
“তারা বলেছে, নতুন অ্যাকর্ড হবে আন্তর্জাতিক অ্যাকর্ড। সেটা সারা বিশ্বের কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তায় কাজ করবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতাকে উদাহরণ হিসেবে নেবে তারা।”
আপনার মূল্যায়ন কী- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই বলিনি। শুধু বলেছি, চুক্তির বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখে আমাদের আইনজীবীদের দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে পরে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাব।’
তবে বাংলাদেশে আর কোনো অ্যাকর্ডের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আদালতের নির্দেশে অ্যাকর্ডের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অন্য কোনো নামে অন্য কোনো উদ্যোগ নিয়ে তাদের আর বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের জন্য অনেক করেছে। ইতোমধ্যে তাদের উদ্যোগে বাংলাদেশের কারখানা নিরাপত্তার বিষয়গুলো যথেষ্ট পরিমাণে সুনিশ্চিত হয়েছে। এখন অ্যাকর্ডের নামে কোনো ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন নেই বলে আমরা মনে করি।’
নতুন অ্যাকর্ডের এই উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করা হয়নি বলে জানান হাতেম।
অ্যাকর্ড কখন গঠন হয়
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। বিদেশি অনেক সংগঠন বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয়।
সেই প্রেক্ষাপটে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি পায়। আর একই লক্ষ্যে গঠিত আমেরিকার ক্রেতাদের জোট পরিচিতি পায় অ্যালায়েন্স নামে।
পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল (আরসিসি) গঠন করে সরকার।
এরপর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কাজ শুরু হয়। দেড় হাজারের বেশি কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন, আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বাস্তবায়ন করা হয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা, যেখানে প্রায় ৪০ লাখের মত কর্মী কাজ করে।
বাংলাদেশে আগের সেই অ্যাকর্ডের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩১ অগাস্ট। তার পরদিন থেকেই নতুন চুক্তি কার্যকর হবে।
নতুন অ্যাকর্ড নিয়ে আর যা যা তথ্য
রয়টার্স-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২০০ রিটোইলার ২০১৩ সালের অ্যাকর্ডে সই করেছিল, যাদের মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম, ইনডিটেক্স, ইউনিক্ল, হুগো, বস আর অ্যাডিডাসের মত বড় কোম্পানিও ছিল। নতুন চুক্তিতে কারা রয়েছে সেই তালিকা ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
ইউনিক্লর একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, তারা নতুন অ্যাকার্ড দেখেননি, তবে সাধারণভাবে তারা আইনি বাধ্যবাধকতা রেখে একটি নতুন চুক্তির ধারণাকে সমর্থন করেন, যেখানে স্বাধীন পর্যবেক্ষণের সুযোগ থাকবে এবং অন্যান্য দেশেও যা সম্প্রসারণ করা যাবে।
নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীরা একমত হয়েছেন যে, নতুন কোন কোন দেশে এই চুক্তি সম্প্রসারণ করা যায়, তা আগামী ছয় মাসের মধ্যে তারা ঠিক করবেন। আপাতত অন্তত একটি দেশে আগামী দুই বছরের মধ্যে একই ধরনের চুক্তিতে তারা পৌঁছাতে চান।
রয়টার্স লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতা কোম্পানিগুলো আইনি বাধ্যবাধকতার চুক্তিতে আপত্তি তোলায় গত মে মাসে অ্যাকর্ডের মেয়াদ বৃদ্ধির আলোচনা থমকে গিয়েছিল।
টার্গট, ওয়ালমার্ট, ভিএফ কর্পোরেশনের মত বড় মার্কিন কোম্পানি ২০১৩ সালে অ্যাকর্ডে যুক্ত হতে আপত্তি তোলে। পরে তারা অ্যালায়েন্স নামে আলাদা জোট করে চুক্তিতে আসে, কিন্তু সেখানে রিটেইলারদের চুক্তি মানতে আইনি বাধ্যবাধকতায় আনার সুযোগ ছিল না।
ওয়ালমার্ট রয়টার্সকে বলেছে, নতুন অ্যাকর্ডেও তারা যুক্ত হয়নি। টার্গেট আর ভিএফ করপোরেশন এ বিষয়ে রয়টার্সের প্রশ্নে সাড়া দেয়নি।