সুরজিত সরকার
করোনা ভাইরাস। ছোট্ট অদৃশ্য। অথচ এমনই পরাক্রমশালী যার জন্য পুরো পৃথিবী ধুঁকছে। শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষকে, অহংকারের চূড়া থেকে নিমিষেই মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। মর্মান্তিকতার একটা সীমা থাকা উচিত যা অতিক্রম করেছে, আপন জনকে শেষ বারের মত ছুঁয়েও দেখতে পারছেন না কেউ।
অনেকেই রয়েছেন প্রিয়জনের থেকে দূরে বিভিন্ন কারণে, তারা অসীম শংকার মধ্যে দিন-রাত পার করছেন দেখা হবে তো! আবার পারবেন কিনা আপনজনের হাতটি ধরতে।
পৃথিবী আবার শান্ত হবে। প্রকৃতির এই খেলা বোঝা মুশকিল। কারণ প্রকৃতি সবসময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। অনেক বছর পর প্রকৃতি নিজেকে সাজাচ্ছে নিজের মত করে। কক্সবাজারে ডলফিন দেখা যাচ্ছে। তীরে ঘুরছে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক।ভারতের রাস্তায় রাস্তায় হাতি, ময়ূর, হরিণ সহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণী দেখা যাচ্ছে।
মানুষ এ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সহযোগিতায় সবকিছু হাতের মুঠোয় নিয়েছে। আত্ম অংহকারে মানুষ হয়ে উঠেছে সর্বেসর্বা। অথচ ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়ত প্রকৃতির এই আয়োজন।মানুষের শিক্ষা প্রয়োজন। এবার হয়ত মানুষ শিক্ষা নিবে, সহনশীল হবে। সরকার থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ করছেন অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও। কিন্তু এখানে ত্রাণ বিতরনের চিত্রটা বেশ সমালোচিত হচ্ছে বৈকি। ত্রাণ বিতরণে ফটোসেশন হয়ে উঠেছে প্রহসন।
মির্জাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তো আরেক কাঠি সরেস। তিনি ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে আবার ত্রাণ কেড়ে নিয়েছেন। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে চাল চুরি। ইতালির মানুষ তাদের টাকা রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবি এমনই বলছে। কারণ তাদের টাকা থাকতেও তারা এই মহামারির প্রকোপ আটকাতে পারেননি। যেখানে বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে একবার যদি মহামারি করোনা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে কোন মানসিকতায় আমাদের দেশের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা ত্রাণের চাল চুরি করছেন। বাংলাদেশ করোনার চতুর্থ স্তরে। দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশ প্রথম মৃত্যু হারের দিকে। আমেরিকা, স্পেন, ফ্রান্স, সুইডেন সহ বাঘা বাঘা দেশ হিমশিম খাচ্ছে করোনা মোকাবিলায় সেখানে আমাদের সম্ভাবনা খুবই ক্ষিণ জেনেও তারা কিভাবে এমনটা করছেন। সৃষ্টিকর্তা না করুন আমাদের দেশের সঙ্গে এমন। তারপরও যদি এই মহামারি তার ধ্বংসযজ্ঞ চালায় আমাদের দেশে তখন কি তারা এই চাল, ত্রাণ সব কিছুর বিনিময়ে করোনার মোকাবিলা করতে পারবেন।
লজ্জায় ত্রাণ নিতে না আসতে পারছেন না অনেকে শুধুমাত্র ত্রাণ দাতাদের ছবি তুলে প্রচারের কারণে। অথচ লজ্জা তো তাদের হওয়া উচিত যারা চুরি করছেন, যারা দেখানো ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলছেন। আমাদের এই মুহুর্তে সবথেকে বেশি জরুরী সরকার, প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। নিয়ম মেনে চলা। দয়া করে পাশের বাসার খোঁজ নেয়া। অভুক্ত আছে কিনা কিংবা কেউ অসুস্থ্য আছে কিনা। বর্তমান সময়ে কারও বাসাতে না যেয়েও খোঁজ খবর করা যায়। তেমন কাউকে পেলে প্রঅসনকে জানান। তারাই খাবার,চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে। কোন এক ওয়ার্ড কমিশনার তার বাহিনী নিয়ে দেদারছে লাঠি পেটা করছেন। এমনটা করার কোন কারণ রয়েছে কি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিয়ম মানতে শুরু করেছে। আসলে এটা ঘটেছে অতি উৎসাহের ফল। দায়িত্ব পেয়ে তারা যেটি করছেন সেটি অতিরঞ্জিত।
নাটোরের বিভিন্ন জায়গাতে ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি তৈরী করা হয়েছে। তাদের হাতে লাঠি। সেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালনের সময় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করছেন তো নিজেদের মধ্যে।যেখানে প্রশাসনের লোকজন লাঠি ছেড়ে গান গেয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছেন সেখানে কেন এই লাঠিপেটা। সরকারের চেষ্টা ও সহানুভূতির মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাণ সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। যেন মানুষ ঘরে থাকে আদতে কি সবাই থাকছেন। টিসিবি’র পণ্য কেনা কিংবা ত্রাণ গ্রহণের লাইন অথবা নিজেদের প্রয়োজনে বাজারে যাওয়া অনেক জায়গাতে মানুষ মানছেন না। এর মধ্যেও নলডাঙ্গাতে শুধু পিঁয়াজের হাট বসছে মাঝ রাত থেকে ভোর পর্যন্ত।
এ বিষয়টি দুই রকম হতে পারে। প্রথমত নলডাঙ্গা অঞ্চলের মানুষ কৃষি পণ্য নির্ভরশীল। এখন পিঁয়াজ উঠেছে। বিক্রি করতে পারলে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা থাকবে কিংবা এই সংকটময় সময়ে পিঁয়াজের ঘাটতি থাকবে না। কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন রাতের আঁধারে কি সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে।নাটোরের বিভিন্ন স্থানে হাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে নলডাঙ্গা হাট চালানো কতটা যৌক্তিক। করোনা ভাইরাস ছড়ানোর দিকে দেখতে গেলে, একেবারেই অনুচিত। কারণ পিঁয়াজ গুলো যাচ্ছে বেশিরভাগ ঢাকাতে। ঢাকা যাতায়াত করছে পণ্যবাহী যে সকল ট্রাক সেই ট্রাকের ড্রাইভার, ক্রেতারা বাহির থেকে আসছেন।
সেক্ষেত্রে এলাকাটি করোনা ভাইরাস ছড়ানোর তালিকাতে থাকছে বলে মনে হয়।সবকিছুর পরেও একটি কথায় থেকে যায়। মানুষ মানুষের জন্য। একদিন ঝড় থেমে যাবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত নিয়ম মেলে হারিয়ে দেয় করোনাকে। তারপর না’হয় নিজেদের হিসেবটা করা যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত যেন কারও পেটের ক্ষিধে, মুখের লাজ আর কারও গলার ফাঁস না হয়ে দাঁড়ায় করোনা অথবা ত্রাণ।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী