নিউজ ডেস্ক:
মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে ॥ অবশেষে কাক্সিক্ষত সেই ক্ষণের জন্য এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন পায়রা বন্দর নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারের লোকজন। প্রথম পর্যায়ের ১১৪ পরিবারকে পুনর্বাসনে প্যাকেজ-১ এর সেমিপাকা বাড়িগুলো এখন প্রস্তুত রয়েছে। মুজিববর্ষের এই উপহার খুব শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর করবেন। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বাড়িহারা মানুষগুলোর স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রথমধাপের খবরটি নিশ্চিত করেছে। ক্ষতির শিকার জেলে ও কৃষক পরিবারগুলো পরিজন নিয়ে পাকা বাড়িতে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছেন। এই প্রকল্পটি নির্মিত হওয়ায় অনগ্রসর অজোপাড়াগাঁ কলাপাড়ার পায়রা বন্দর এলাকার লালুয়া ইউনিয়নের মেরাউপাড়া গ্রামটিতে এখন পৌঁছে গেছে শহরের সুবিধা। মানুষগুলো কখনও স্বপ্নে ভাবেননি ঘর-বাড়ি-গাছপালা জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার পরও চার কাঠা এবং তিন কাঠা জমিতে নির্মিত একতলা পাকা বাড়ি পাবেন। স্বপ্নের এই বাড়ির দ্বার উন্মোচনের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন দরিদ্র-হতদরিদ্র জেলে-কৃষকসহ হাইলা-কামলা শ্রেণীর মানুষ। অতিসম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রী মোঃ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী পুনর্বাসন প্রকল্পের এক নম্বর প্যাকেজসহ তিনটি প্যাকেজ পরিদর্শন করেন। তিনি নবনির্মিত বাড়ির কক্ষসহ বিভিন্ন দিক ঘুরে দেখেন। নেন খোঁজ-খবর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রই প্রথম প্যাকেজের উদ্বোধন করবেন বলে মন্ত্রী নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনায়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কেউ ভূমিহীন হয়নি। একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দেশের মানুষের মৌলিক সমস্যা বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যসহ সবকিছু সমাধান করছেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার পাঁচ শ’ পরিবারকে ১৪টি প্যাকেজের মাধ্যমে পুনর্বাসনের কাজ চলছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর হুমায়ুন কল্লোলও বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে সুদৃশ্য, দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প এলাকা। প্যাকেজ এক-এর অধীনে ১৫ একর জমিতে ভূমি উন্নয়নের পর সুদৃশ্য পাকা একতলা বাড়িগুলো নির্মিত হয়েছে। ১১৪টি বাড়ির মধ্যে এ টাইপের ৩৬টি এবং বি টাইপের রয়েছে ৭৮টি। চার কাঠা জমির ওপরে এ টাইপ এবং তিন কাঠা জমিতে বি টাইপের একেকটি বাড়ি নির্মিত হয়েছে। সারিবদ্ধভাবে করা বাড়িগুলো দেখলে যে কারও ভাল লাগবে। প্রত্যেকটি বাড়িতে তিনটি বেডরুম, দুইটি বাথরুম, একটি কিচেন, একটি বারান্দা রয়েছে। যার মধ্যে সংযুক্ত বাথরুমসহ একটি মাস্টার বেডরুম রয়েছে। প্রতি চারটি বাড়ির জন্য একটি সেপটিক ট্যাংক ও একটি সোক ওয়েল রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ছাদে রিজার্ভ ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। নামাজের জন্য সুউচ্চ মিনার সংবলিত ঈদগাঁহসহ দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে একসঙ্গে পৌনে তিন শ’ মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবেন। এই প্যাকেজের বাসীন্দাদের জন্য দুইটি গভীর নলকূপ ও একটি ভূগর্ভস্থ জলাধারসহ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরসিসি ও ইটের গভীর-অগভীর ড্রেনেজ সিস্টেম করা হয়েছে। ১৬, ১৮ ফুট এবং ২৪ ফুট প্রশস্ত অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। করা হয়েছে পাকা ঘাটলাসহ পুকুর। ১০ কক্ষবিশিষ্ট মার্কেট করা হয়েছে। রয়েছে স্কুল কাম কমিউনিটি ক্লিনিক। মাছ বাজারের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছাড়াও শাক-সবজি বিক্রির উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়েছে। রয়েছে খেলার মাঠ। একটি কবরস্থান। বাড়ির সামনে পরিবেশবান্ধব সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে। গার্ডেনিং-এর জন্য খালি স্পেস রাখা হয়েছে। এক কথায় কি নেই। যা করা হয়নি এই পুনর্বাসন প্রকল্পে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্যাকেজ এক-এর নির্মাণ কাজ করেছে। ইতোমধ্যেই এসব পুনর্বাসিত মানুষের কর্মদক্ষতার উন্নয়নে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সেলাই, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন, ড্রাইভিং, বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ ২২টি ট্রেডের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ চলমান রয়েছে। পায়রায় ছয় হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত মোট ৪২০০ পরিবারের একজন করে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি ট্রেডের ১০৪টি ব্যাচের ২৬০০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৯৭৫ জন বিভিন্ন ট্রেডে আয়বর্ধনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, পায়রা বন্দর নির্মাণের জন্য ছয় হাজার ৫৬২ দশমিক ২৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের কার্য কলাপাড়ায় চলমান রয়েছে। এজন্য ৩৪২৩টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ‘পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/সুবিধাদি ও উন্নয়ন (২য় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৪৮৪ একর জমিতে ১৪টি প্যাকেজে সাতটি কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবাররের পুনর্বাসনকল্পে প্রায় ৩৪২৩টি বাড়ি নির্মানণাধীন রয়েছে। যার মধ্যে এ টাইপের ১১৬৫টি (চার কাঠার) এবং বি টাইপের ২২৫৮টি (তিন কাঠার)। ১৪টি প্যাকেজের মোট চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা রয়েছে এক হাজার ৪২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সামগ্রিকভাবে এ প্যাকেজের ভৌত অগ্রগতি ৬৪ দশমিক ৫১ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬০ দশমিক ২৮ ভাগ। বর্তমানে ২০২৫টি বাড়ির ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে ২৩৫০টি বাড়ির। এ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৮৫০ জনের ১২টি ট্রেডের ওপর ৩৪টি ব্যাচে প্রশিক্ষণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি ব্যাচের ৩৫০ জনের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। বর্তমানে পুনর্বাসনের প্রথম প্যাকেজের ১১৪টি নির্মিত সুসজ্জিত বাড়ি আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের জন্য রেডি রয়েছে। পুনর্বাসিত মানুষগুলো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন সেই ক্ষণের জন্য। আর পায়রা বন্দরে জমি, বাড়িহারা এই ১১৪ পরিবারকে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছে। লালুয়ার মেরাউপাড়া গ্রামটি এখন ওখানকার সকল মানুষের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সকলেরই দাবি প্রধানমন্ত্রী তাদের আগের চেয়েও ভাল এবং আধুনিক সুবিধার বাড়ি দিচ্ছেন। তবে কেউ কেউ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। লালুয়ার চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দাবি করেন, যাদের বাড়িঘর অধিগ্রহণে নেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেককে দ্রুত পুনর্বাসনের আওতায় আনা হোক। এছাড়া বাড়িঘর এবং জমি হারাদের ক্ষতিপূরণের টাকার চেক কলাপাড়ায় বসে প্রদানের দাবিও করেন তিনি।