নিউজ ডেস্ক:
দুইশ মিটার দৈর্ঘ্যরে সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়েছে পায়রাবন্দরে। এর আগে আর এত লম্বা জাহাজ নোঙ্গর করেনি এখানে। কয়লা নিয়ে বৃহস্পতিবার এটি আসে পায়রায়। ৭ দশমিক ৫ মিটার গভীরতা নিয়ে জাহাজটি যখন বন্দরে ভেড়ে সবার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দ। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, ‘আরও গভীর ড্রাফট-র সমুদ্রগামী জাহাজ বন্দরে আনার স্বপ্ন দেখছি আমরা। আশা করছি চলতি বছরই তা সম্ভব হবে। বর্তমানে যে গতিতে ড্রেজিংসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে তাতে এ বছরের শেষের দিকে এখানে কনটেইনার এবং বাল্ক জাহাজও ভিড়তে পারবে।’
গত বছরের এপ্রিলে হঠাৎ করেই বলা হয় গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে না পায়রায়। গণমাধ্যমে সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। কারণ হিসাবে নাব্য জটিলতার কথা বলেন তিনি। বন্দর থেকে রামনাবাদ চ্যানেল হয়ে গভীর সমুদ্রের দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। প্রতিবছরই এই চ্যানেলে জমে বিপুল পলি। সেক্ষেত্রে চ্যানেল চালু রাখতে ড্রেজিং খাতে ফি বছর ব্যয় করতে হবে শত শত কোটি টাকা। তাছাড়া ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে চ্যানেলের গভীরতা ১৪ থেকে ১৫ মিটারে নেওয়া এবং তা অব্যাহত রাখাও দুরূহ বলে তখন মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
সরকারের এই সিদ্ধান্তে হতাশ হয়ে পড়েন বরিশাল-পটুয়াখালী তথা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। থমকে যায় পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে সবার স্বপ্ন। হুমকির মুখে পড়ে এই বন্দর ঘিরে বিভিন্ন বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ করা হাজার কোটি টাকা। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই পায়রাবন্দরের। কিন্তু আশার আলো যে একেবারই নিভে যায়নি তার প্রমাণ দিতে শুরু করেছে পায়রা সমুদ্রবন্দর। নিয়মিত এ বন্দরে আসছে সমুদ্রগামী জাহাজ। দিন দিন বাড়ছে ভিড়। বাড়ছে রাজস্ব আয়। তাছাড়া পায়রাকে ঘিরে সরকারের নেওয়া প্রায় সব উন্নয়ন পরিকল্পনাই রয়েছে অব্যাহত। শুধু বাদ পড়েছে ‘গভীর’ শব্দটি।
২০১৩ সালের নভেম্বরে জাতীয় সংসদে পাশ হয় পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন। এরপর দুদফায় ৪৮ একর জমি অধিগ্রহণের পর শুরু হয় বন্দর নির্মাণ। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষে ২০১৯ সালের শেষের দিকে প্রথম আমদানি পণ্য নিয়ে বন্দরে ভেড়ে জাহাজ। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি পায়রাকে। দেশের তৃতীয় এ সমুদ্র বন্দরে ২ বছরে ১৭০টি বিদেশি জাহাজ ভিড়েছে। পণ্য খালাসের মাধ্যমে এ বন্দর আয় করেছে ৩৫০ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, চলতি শীত মৌসুমেও প্রায় ৮ মিটার গভীরতা রয়েছে রামনাবাদ চ্যানেলে। গভীর সমুদ্র থেকে এ চ্যানেল ধরেই বন্দরে আসতে হয় সমুদ্রগামী জাহাজকে। ৭ মিটারের বেশি পানি দরকার হয় এমন জাহাজগুলো এসে থামে বহির্নোঙরে। সেখান থেকে প্রথমে লাইটারেজে (ছোট জাহাজ) খালাস করা হয় কিছু পণ্য। ড্রাফট (জাহাজের গভীরতা) যখন ৭ মিটারে পৌঁছায় তখন জাহাজ সরাসরি এসে নোঙ্গর করে বন্দরে। এরপর বাকি পণ্য নামানো হয় সেখানেই। এ পদ্ধতিতে পণ্য খালাস শুধু পায়রাতেই হচ্ছে তা নয়, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরেও এভাবেই খালাস হয় পণ্য।
নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, পায়রাবন্দর প্রকল্প বাতিল হওয়ার মতো কোনো কিছু কখনোই বলা হয়নি। এটা সম্ভবও নয়। কেননা, ১৮ থেকে ২০টি প্রকল্প সমন্বিত রয়েছে পায়রাবন্দরের সঙ্গে। এরমধ্যে রয়েছে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, গার্মেন্টস শিল্প এলাকা, বিমানবন্দর স্থাপন, রেল সংযোগ, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প, ট্যুরিজম, লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল ও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ। ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চলছে এসব কাজ। সম্ভাব্যতা যাচাইসহ জমি অধিগ্রহণ পর্যন্ত করে ফেলেছে তাদের অনেকেই। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে কলাপাড়ায় এরইমধ্যে গড়ে উঠেছে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে কয়লা ও জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার স্থাপনেরও কাজ চলছে। এককথায় বলা যায়, ১৮-২০টি বৃহৎ প্রকল্পের সমন্বিত রূপ হচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দর। সূত্রের দাবি, এখনো চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের তুলনায় পায়রা সমুদ্রবন্দর অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। কারণ, যে ওই দুটি সমুদ্রবন্দরের চেয়ে পায়রা থেকে রাজধানী ঢাকায় পণ্য পৌঁছানো প্রশ্নে নদী বা সড়কপথ-উভয় মাধ্যমেই সময় ও খরচ অনেক কম লাগবে।
পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতি মুহূর্তেই বন্দরের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি আমরা। যদিও এ বন্দরের অধিকাংশ অবকাঠামোগত নির্মাণ এখনো বাকি। তারপরও বর্তমান সক্ষমতার প্রায় সবটুকু ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। বৃহস্পতিবার এখানে ২শ মিটার দৈর্ঘ্যরে কয়লাবাহী একটি জাহাজ এসেছে। এখন পর্যন্ত এটাই বন্দরে নোঙ্গর করা সবচেয়ে লম্বা জাহাজ। এর আগে ১৯০ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে জাহাজ এসেছে। এরমধ্যেই এখানে ১৭০টি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করেছি। রামনাবাদ চ্যানেলে ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে জাহাজ আসার সংখ্যা আরও বাড়বে। আশা করছি যে চলতি বছরের শেষের দিকে এখানে কনটেইনারবাহী ও বাল্ক জাহাজ ভেড়ার মতো সক্ষমতাও অর্জন করতে পারব আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘পায়রাবন্দর মাত্র যাত্রা করেছে। এ বন্দরকে আমরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তিতে পরিণত করতে পারব।’
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘পায়রাবন্দরকে ঘিরে বরিশাল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাব হবে এই স্বপ্ন আমাদের সবার। গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে না শুনে প্রথম দিকে খানিকটা হতাশ হলেও বর্তমানে পায়রা সমুদ্রবন্দর যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আশার আলো দেখছি আমরা। বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হোক সেটাই এখন আমাদের দাবি।’