নিউজ ডেস্ক:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, পাঁচ চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে কাজ করছে ঢাকা। প্রাথমিকভাবে ‘বাংলাদেশ-জাপান কৌশলগত অংশীদারত্ব উন্নয়ন’ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর টোকিও সফরে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে।
কিছুদিন আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করেছিলেন। দু’দেশের বহুমুখী সহযোগিতার দৃঢ় অংশীদারত্ব উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করতে এই পাঁচ চ্যালেঞ্জ জয়ের কথা বলেন তিনি।
ইতো নাওকি সেদিন বলেন, এই পাঁচ চ্যালেঞ্জ হলো: বাংলাদেশ-জাপানের কৌশলগত অংশীদারত্বের উন্নয়ন ঘটানো, বাংলাদেশকে বিনিয়োগের জন্য আরও আকর্ষণীয় করা, জনগণের মধ্যে বিনিময় সম্প্রসারণ, অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা বাড়ানো এবং এই অঞ্চলে ও এর বাইরে বাংলাদেশের সম্মান বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই পাঁচ চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে কাজ করছে ঢাকা। প্রাথমিকভাবে ‘বাংলাদেশ-জাপান কৌশলগত অংশীদারত্ব উন্নয়ন’ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর টোকিও সফরে এই বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে।
এদিকে জাপান এই সফরে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে সক্রিয় অংশীদার’ হিসেবে মাথায় রেখেই এগিয়ে যেতে চায় বলে ধারণা দিয়েছে টোকিও। তবে এই ইস্যুতে বাংলাদেশ অবস্থান পরিবর্তন করেনি বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে এই অঞ্চলে অনেকেরই অনেক পরিকল্পনা আছে। আমরা তো জাপানের সঙ্গে তাদের “বিগ বি” নিয়ে কাজ করছি।’
বঙ্গোপসাগরের তীরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম ঘিরে ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ’ (বিগ-বি) উদ্যোগকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন বিনিয়োগ সুযোগ তৈরির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘এই অঞ্চলে অন্যদের ও নানা পরিকল্পনা আছে। এরই মধ্যে ফ্রান্সও ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। তবে আমরা সব ধরনের অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কে রাজি আছি। কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি বা প্রতিযোগিতায় ঢাকার মত নেই। এই কারণেই কোনো সামরিক জোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঢাকার।’
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত হবে। জাপান বাংলাদেশের খুব ভালো বন্ধু দেশ এবং উন্নয়ন অংশীদার। দুই পক্ষের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া আছে। তারপরও জাপান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সক্রিয় সহযোগিতা করছে না।
‘এটা পরিষ্কার যে জাপান… এ অঞ্চলে তাদের অনেক স্বার্থ রয়েছে। তারা এখানে কী যেন করছে… বিগ বি…। তার ফলে তাদের মিয়ানমারেও বড় ইন্টারেস্ট রয়েছে। জাপান সব সময়ই এ বিষয়ে আগ্রহী। কিন্তু এ বিষয়ে তিন দেশের কোনো মিটিং আয়োজন করতে আমরা এখনও দেখিনি।’
মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় দুই পক্ষের সম্পর্ক সমন্বিত সম্পর্কের পর্যায়ে উন্নীত হয়। দুই পক্ষ এই সম্পর্ককে এখন কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করতে কাজ করছে। ওই সময়েই জাপানের ‘বিগ বি’ উদ্যোগের (বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ) আওতায় দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সিদ্ধান্ত হয়।
জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আরিমা ইয়ুতাকা আশা প্রকাশ করছেন, দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন জাপান সফর ইতিহাসের পাতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
জাপানের বিগ বি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, জাপানের কাছে বাংলাদেশ খুবই আকর্ষণীয়। এ কারণে ২০১৪ সাল থেকে জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পরামর্শে বিগ বি উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কেন্দ্র এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিগ বি উদ্যোগ বাংলাদেশ ছাড়াও এই অঞ্চলের একাধিক রাষ্ট্রে বাস্তবায়নাধীন। ইন্দো-প্যাসিফিকের মূল ধারণা জাপানের বিগ বি উদ্যোগ থেকেই নেয়া।
ভূ-কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত এবং বাংলাদেশের অবস্থান এমন যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
নিঃস্বার্থ আর্থিক ও উন্নয়ন সহযোগি বন্ধু জাপান
আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে আসছে জাপান। বর্তমানে জাপানি ওডিএ-এর সবচেয়ে বড় গন্তব্য বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে জাপানের মোট সহযোগিতার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২৫ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশটির কাছ থেকে আরও ২৬৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর তুলনায় বেশ শিথিল শর্তেই বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে থাকে জাপান। বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সাম্প্রতিক স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তিগুলোয় সুদহার ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ বছর। এর সঙ্গে গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়েছে আরও ১০ বছর।
ঢাকায় অবস্থিত জাপানের দূতাবাস সূত্র জানায়, ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান ২ হাজার ৯৪৫.২৭ মিলিয়ন ডলার অনুদান সহায়তা, ৩৪১.১০ মিলিয়ন ডলারের কারিগরি সহায়তা এবং ৪ হাজার ৮৫৯.৯৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩২৪টি জাপানি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে জাপানের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) স্থিতি হচ্ছে ৪১১.৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ জাপানে ১ হাজার ১৮৩.৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে এবং জাপান থেকে বাংলাদেশে ৭৯.৫৪ মিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে।
জাপান দূতাবাস জানায়, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় অংশীদার জাপান। তাদের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এ দেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পদ্মাসেতুর আগে দেশের অবকাঠামো খাতের সবচেয়ে বড় মাইলফলক বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু (যমুন সেতু) তৈরিতে ভূমিকা ছিল জাপানের। বর্তমানে তারা এই সেতুর পাশেই একটি রেলসেতু তৈরি করছে। পদ্মাসেতুর সম্ভাব্যতাও যাচাই করে জাইকা। বর্তমানে হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে জাইকার সহায়তায়। রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল সেবা বাস্তবায়ন শেষে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মাত্র ৩৫ মিনিটে দিনে চার লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী পরিবহন সুবিধা পাবে। এই লাইন ছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় মোট ছয়টি মেট্রোরেল ও পাতালরেল নির্মাণ করতে সহায়তা করবে জাপান।
জাপানের সহায়তায় বর্তমানে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হচ্ছে জাপানের সহায়তায়। বাস্তবায়ন শেষে এই গভীর সমুদ্রবন্দর মিয়ানমারের সিতওয়ে, সিঙ্গাপুর এবং ভারতের কলকাতা, বিশাখাপতনম এবং চেন্নাইয়ের সঙ্গে সমুদ্রপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে। মাতারবাড়ীতে মহেশখালী-মাতারবাড়ী ইন্টিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (মিডি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাপান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি বিনিয়োগের প্রধান গেটওয়ে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক মিত্র মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান এবং এ অঞ্চলে চীনের ক্রমশ আগ্রাসী বিনিয়োগ টোকিওকে দক্ষিণ এশিয়ামুখী হতে বাধ্য করেছে। আর এর পুরো সুফলই পেতে যাচ্ছে ঢাকা।
বাংলাদেশ হচ্ছে জাপানের বিনিয়োগ গেটওয়ে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো দক্ষিণ এশিয়ায়ও আর্থিক সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে জাপান। এ অঞ্চলে প্রচুর উন্নয়ন সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে টোকিও। এর মধ্যে বাংলাদেশেই জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশও জাপানকে দেখছে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে।
বিগত দশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে মিয়ানমার পরিচিতি পায় এশিয়ার ‘ফ্রন্টিয়ার মার্কেট’ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল জাপান। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক সরকারের পতন এবং সেনা অভ্যুত্থানে নাখোশ জাপানি বিনিয়োগকারীরা চাইছে মিয়ানমার থেকে বিদায় নিতে। তাদের কাছে এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় গন্তব্য।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সদ্য বিদায়ী নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপান খুব পরিচ্ছন্ন ব্যবসা করে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি: সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। সে ক্ষেত্রে এখানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির কোনো প্রভাব থাকবে বলে আমি মনে করি না।’
জাপানি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত ও অকৃত্রিম বন্ধু দেশ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৩ সালের ঐতিহাসিক জাপান সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এটি ছিল অংশীদারত্বের সূচনা, যা দিনে দিনে শক্তিশালী হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী জানান, জাপানি অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু সড়ক ও যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু, ঢাকা শহরের মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মাতারবাড়ী পাওয়ার প্লান্ট, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরসহ চলমান বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প চলমান।