ইন্টারমিডিয়েটের ফরম ফিলাপের টাকা যোগার করতে পারেননি তার বাবা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকা আসবার সময় পকেটে ট্রেন ভাড়াটাও ছিল না।
তাই টানা দুই দিন ধরে কখনো হেঁটে, কখনো ট্রেনের চেকারকে ফাঁকি দিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পড়তে আসতেন তিনি। পড়াশোনার চালাতে গিয়ে অন্যের বাসায় থেকেছেন লজিং। আজ সেই অন্যের বাড়িতে লজিং থাকা ছেলেটির হাতে সারা দেশের বাজেট।
বলছি দেশের ১১ তম অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কথা। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট। প্রাথমিকভাবে আসছে বাজেটের মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ।
৭২ বছর বয়সী এই অর্থমন্ত্রীর কাছে সফলতার গল্প শুনতে চাইলে তিনি প্রায়ই বলেন, জীবন তো শুরুই হলো না। জীবনে আরো অনেক কাজ বাকি। আমাকে আরো কাজ করতে হবে।
চলুন জেনে নেয়া যাক তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার সম্পর্কে: কুমিল্লার সন্তান মোস্তফা কামাল শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের (তদানীন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) মধ্যে সম্মিলিত মেধা তালিকায় চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে সর্বোচ্চ কৃতিত্বের রেকর্ড অর্জন করেন। তিনি দুই দশকের অধিক সময় আবাহনী ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি দেশের একজন খ্যাতনামা হিসাব বিজ্ঞানীও।
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বাগমারা ইউনিয়নের দত্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাইমারি শিক্ষা শেষে বাগমারা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৬২ সালে এসএসসি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ হতে এইচএসসি, ১৯৬৪-’৬৭ সালে চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্যিক কলেজ হতে বি.কম (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭-’৬৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে হিসাব বিজ্ঞান ও আইন বিভাগে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। মেধাবী এ নেতা ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের (পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান) চার্টার্ড একাউনটেন্সী পরীক্ষায় মেধা তালিকায় সম্মিলিতভাবে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পাকিস্তানের চার্টার্ড একাউন্টেন্সী পরীক্ষায় তিনিই একমাত্র বাঙ্গালী যিনি প্রথম স্থান অধিকার করার এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। দুই পাকিস্তানের রেকর্ড সংখ্যক মার্ক নিয়ে পাস করে ‘লোটাস’ খ্যাতি পাওয়া সনদপ্রাপ্ত হিসাববিজ্ঞানী (চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট)। চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পরীক্ষায় প্রথমস্থান অর্জন করেছিলেন তিনি।
মেধাবী এই নেতার রাজনীতির হাতের খড়ি ছাত্রজীবন থেকেই। কলেজ জীবনের পুরোসময়ই তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় তিনি আওয়ামী লীগের একজন নিবেদীত সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রার্থী হয়ে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন কুমিল্লা-৯ সদর দক্ষিণ (যা বর্তমানে কুমিল্লা-১০ সদর দক্ষিণ, লালমাই, নাঙ্গলকোট) সংসদীয় আসন থেকে প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময়ে তিনি পাবলিক একাউন্টস কমিটির সদস্য, বিনিয়োগ বোর্ডের সদস্য, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সদস্য, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, যাকাত বোর্ডের সদস্য এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত আছেন। ২০০৬ সালের ১২ মে থেকে তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-১০ নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রার্থী হয়ে দ্বিতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-১০ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রার্থী হয়ে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে চতুর্থবারের মত সংসদ সদ্য হিসেবে বিজয়ী হন।
আ হ ম মুস্তফ কামাল ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
তার পরিবারে ৩ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার স্ত্রী কাশমেরী কামাল একজন সফল ব্যবসায়ী। তার দু’টি কন্যা সন্তার রয়েছে। এর মধ্যে বড় মেয়ে কাশফী কামাল স্বপরিবারে প্রবাসী এবং ছোট মেয়ে নাফিসা কামাল তার বাবার মতো ক্রীড়ানুরাগী ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের চেয়ারপার্সন। তার মেয়েও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে সারা দেশে এবং বিশেষ করে কুমিল্লায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী শুধু রাজনীতি বা পড়াশোনা নিয়েই থাকেননি। খেলাধুলার প্রতি রয়েছে অসম্ভব ভালোবাসা। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। তিনি ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্বকালে বাংলাদেশে ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়। তিনি গত ৩০ বছরেরও অধিক সময় ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত। এ সময়ে তিনি ক্রিকেটের উন্নয়নে বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে প্রশংসনীয় অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ২০১৪ সালের ১লা জুলাই থেকে তিনি আইসিসি’র নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর আগে তিনি আইসিসি’র সহ-সভাপতি, অডিট কমিটির সভাপতি এবং এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।