নিউজ ডেস্ক:
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৮ মাসে ১৯টি কারখানা নতুন করে পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ পেয়েছে। তাতে দেশে পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্র কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫। নির্মাণাধীন আছে প্রায় ৫০০ পরিবেশবান্ধব কারখানা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, পরিবেশবান্ধব কারখানায় বিদ্যুৎ ও পানির খরচ কম হয়। কার্বন নিঃসরণও কম। শ্রমিকেরাও ভালো পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পান। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক দিয়ে অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের ধারেকাছেও নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা পরিবেশবান্ধব কারখানার ব্র্যান্ডিং করলেও সামগ্রিকভাবে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে না। অথচ সেটি করা গেলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। তাতে পুরো পোশাক খাতই উপকৃত হতো।
সারা বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। তারা ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। গত বছরের নভেম্বরে সারা বিশ্বে লিড সনদ পাওয়া বাণিজ্যিক স্থাপনার সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। লিড সনদের জন্য নয়টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ ও ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে।
বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলো ইউএসজিবিসির অধীনে সনদ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বরাত দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৪৪টি স্থাপনা লিড সনদ পেয়েছে। তার মধ্যে লিড প্লাটিনাম ৪১টি, গোল্ড ৮৭টি, সিলভার ১৪টি ও ২টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। সনদ পাওয়া ১৪৪টি স্থাপনার মধ্যে পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানা ১২৫টি। পোশাক ও বস্ত্র কারখানার বাইরে শিপইয়ার্ড, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বাণিজ্যিক ভবনও আছে।
লিড গোল্ড সনদ পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা ধামরাইয়ের স্নোটেক্স আউটারওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানায় বিদ্যুৎ ও পানির খরচ কমানো যায়। এতে উৎপাদন খরচ কমে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। তিনি আরও বলেন, অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড তাদের সোর্সিং তালিকায় পরিবেশবান্ধব কারখানা রাখতে চায়। সে কারণে পরিবেশবান্ধব কারখানার মাধ্যমে বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ডকে আকর্ষণ করা তুলনামূলক সহজ হয়। এতে তাদের কাছ থেকে দীর্ঘদিনের বুকিং পাওয়া যায়।
পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের ভেতরে সবুজের সমারোহ।
পরিবেশবান্ধব কারখানা করলেও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন এস এম খালেদ। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদন খরচ যতটুকু কমানো যায়, তার সঙ্গে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি না করতে পারলে সুবিধা করা যাবে না।
সাধারণত অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ৫-২০ শতাংশ খরচ বেশি হয়। তবে বাড়তি খরচ করলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ২৪-৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ, ৩৩-৩৯ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ ও ৪০ শতাংশ পানির ব্যবহার কমানো সম্ভব। তার মানে দেশে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই তা পরিবেশের ওপর চাপ কমাবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
চলতি বছর যেসব কারখানা লিড সনদ পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ইএমএস অ্যাপারেলস লিমিটেড, প্যাসিফিক ক্যাজুয়াল, আনোয়ারা ফ্যাশনস, কারুনী নিট কম্পোজিট, ডেবনিয়ার গ্রুপের প্যাডিং ও হোমওয়্যার ইউনিট, কারুপণ্য রংপুর, ভারটেক্স ওয়্যার ড্রেস ওয়ার্ল্ড নিও ফ্যাশন, মেঘনা ডেনিমস, পেনউইন ডিজাইনস, আলফা ক্লথিং, মেবল অ্যান্ড ফ্রাঙ্ক ফ্যাশনস, ফ্যাশন এশিয়া, নিপ্পন গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ, এভিটেক্স ড্রেস শার্ট ইত্যাদি
পোশাক ও বস্ত্র খাতের পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে লিড প্লাটিনাম ৩৪টি, গোল্ড ৭৯, সিলভার ১০ ও ২টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করা তিনটি পোশাক কারখানা হচ্ছে রেমি হোল্ডিংস, তারাসিমা অ্যাপারেলস ও প্লামি ফ্যাশনস।
জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব কারখানার বিষয়ে উদ্যোক্তারা নিজেরা ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করেছেন। তবে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং করা যায়নি। সেটি করা গেলে পুরো পোশাকশিল্প উপকৃত হতো। সে জন্য সরকার বা ব্যবসায়িক সংগঠন পর্যায়ে উদ্যোগ দরকার। অবশ্য করার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। অথচ পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের ধারেকাছেও নেই কোনো প্রতিযোগী দেশ।’ পোশাকের দাম বেশি পাচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিতে পারছি। তবে সেটি প্রত্যাশা অনুযায়ী নয়।’