নিউজ ডেস্ক:
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সার আমদানি কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও গম, চাল, তেল, চিনির মতো খাদ্যপণ্য আমদানিতে ডলারের সংস্থান করতে হবে। খাদ্য সরবরাহে যেন কোনো সংকট তৈরি না হয় তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
সভায় উপস্থিত সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মন্দা ও দুর্ভিক্ষের প্রভাব যাতে না পড়ে সে জন্য সতর্ক থাকার তাগিদ দিচ্ছেন। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব পরিস্থিতির কিছু প্রভাব ইতোমধ্যে দেশে পড়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ম্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। ডলার সংকটে কিছু ক্ষেত্রে নিত্যপণ্য আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী এ বৈঠক ডাকেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাবিবুর রহমান, শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা, খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি, অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন প্রমুখ।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় যেন কোনো সংকট তৈরি না হয় তা নিশ্চিত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামীতে কোনো দুর্যোগে যাতে বড় সমস্যা তৈরি না হয় সেজন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরের যথাযথ সহযোগিতা নিশ্চিত করতে খাদ্য সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ গরিব মানুষের জন্য চলমান সরকারি কার্যক্রমে যাতে কোনো অনিয়ম না হয় তা কঠোরভাবে তদারক করতে বলেছেন।
সূত্র আরও জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে হুন্ডি কারবারে জড়িতদের খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে হুন্ডির সুবিধাভোগী কারা, তা বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি আয় যেন না কমে, সে বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।
বৈঠকে বিভিন্ন খাতে সরকারের ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে রয়েছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান আর্থিক চাপের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভর্তুকির চাপ কমাতে এ ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। প্রথমত, দর বাড়ানোর মাধ্যমে ভর্তুকি সমন্বয় করা। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ আরও কমিয়ে ভর্তুকি কমানো। যদিও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী ১ কোটি মানুষকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির কম দামে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে সরকারের বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সূত্র জানায়, মানুষের কষ্ট কমাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক্ক-কর কমানো যায় কিনা ভাবতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে, বিলাসবহুল এবং খুব প্রয়োজনীয় নয় এমন কিছু পণ্য আমদানিতে এরই মধ্যে শুল্ক্ক বাড়ানো হয়েছে। শুল্ক্ক আরও বাড়াতে কিংবা শুল্ক্ক বাড়ানোর তালিকায় নতুন কিছু পণ্য যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন একজন সচিব। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যাতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে সে বিষয়ে নির্দেশনা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আমদানি ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে পার্থক্য কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিলাসবহুল দ্রব্যের আমদানি কমাতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ ও তদারকি জোরদার করা হয়েছে। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী জানুয়ারি থেকে ডলার বাজার স্বাভাবিক হওয়ার আশা প্রকাশ করেন গভর্নর। বৈঠকে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার সারসংক্ষেপ এবং বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিলে অর্থনীতিতে তার প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে আরও পর্যালোচনার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নতুন এলসি খোলা কমছে। যদিও আগে খোলা এলসির দায় পরিশোধ বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এলসি খোলা ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর কারণ, বেশিরভাগ এলসির দেনা পরিশোধ হয় পণ্য দেশে আসার পর। আর এ ক্ষেত্রে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে। গত ৩১ অক্টোবর ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সরকারি জরুরি আমদানির বাইরে ডলার সহায়তা করা হবে না। ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব উৎসে ডলার সংস্থান করে এলসি খুলতে হবে। এর পর থেকে ডলার বিক্রি কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবশ্য চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৫০৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।