নিউজ ডেস্ক:
গত এক বছরে প্রায় ৮০ হাজার নতুন কোম্পানির খোঁজ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এত দিন এনবিআরের খাতায় এসব কোম্পানির নাম ছিল না। এসব কোম্পানির মালিকেরা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেননি, বছর শেষে লাভ-লোকসান নির্বিশেষে কোনো করও দেননি। বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়ে গেছেন কোম্পানির মালিকেরা। অথচ টিআইএন নিয়ে এসব কোম্পানির কর দেওয়া বাধ্যতামূলক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করপোরেট কমপ্লায়েন্স নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স এসব লুকিয়ে থাকা কোম্পানির খোঁজ পেয়েছে। গত বছরের আগস্টে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) পরিচালক শব্বির আহমেদের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠিত হয়। এখন ওই টাস্কফোর্স কোম্পানির ঠিকানা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর কমিশনারেটের মাধ্যমে টিআইএন ইস্যু করছে।
বিজ্ঞাপন
কোম্পানি গঠন করে টিআইএন না নেওয়ার কিছু অভিনব উদাহরণ পেয়েছেন এনবিআরের ওই টাস্কফোর্সের সদস্যরা। যেমন চট্টগ্রামের একটি শিল্পগোষ্ঠীর একজন পরিচালক একসঙ্গে ৪৬টি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ওই শিল্পগোষ্ঠীর সেবা, উৎপাদন, ট্রেডিং ব্যবসা আছে। কিন্তু ওই ৪৬টি কোম্পানির মাত্র চারটি কোম্পানির টিআইএন আছে। টাস্কফোর্স এখন বাকি সব কোম্পানিকে টিআইএন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এই পর্যন্ত ২০টি কোম্পানিকে টিআইএন দিয়েছে। আরেকটি কোম্পানি অর্ধশতাব্দী ধরে ব্যবসা করে আসছে। কিন্তু কখনো কর দেয়নি। আবার একই ঠিকানা ব্যবহার করে শত শত কোম্পানি খোলার নজিরও আছে। যেমন কারওয়ান বাজারের দুটি ঠিকানা ব্যবহার করে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি খোলা হয়েছে। বাস্তবে ওই ঠিকানায় এসব কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
টাস্কফোর্সের ওই প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিআইএনবিহীন কোম্পানি খুঁজে বের করতে গিয়ে টাস্কফোর্স খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বেদনাক্রান্ত দেশের এক করুণ চিত্র। এত এত কোম্পানির কর না দেওয়া সম্পর্কে টাস্কফোর্স বলেছে, এই পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দেশের আর্থিক খাতের সুশাসনের ঘাটতি।
কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হলেও কোন কোন কোম্পানি কর দেয় না, তা খুঁজে বের করতে গত বছরের আগস্ট মাসে কাজে নামেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। এক বছর ধরে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) ও এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর সার্কেল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন কর গোয়েন্দারা।
এই বিষয়ে এনবিআরের সিআইসির মহাপরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার কোম্পানি আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েও কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যত কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে, সবাইকে টিআইএন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টাস্কফোর্সের কাজ চলমান আছে। আবার যেসব কোম্পানি টিআইএন নিয়েও কর দেয়নি, তাদের রিটার্ন দিতে বাধ্য করা হবে। লোকসান দেখিয়ে যাতে কর ফাঁকি দিতে না পারে, সে জন্য নিরীক্ষা প্রতিবেদন সঠিক কি না, তা যাচাই-বাছাই করা হবে। কারণ, কর ফাঁকি দিতে ভুয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনে লোকসান দেখানো হয়।
করের বাইরে ৮০ হাজার কোম্পানি
আরজেএসসির হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪০০ প্রতিষ্ঠান কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত। এনবিআরের টাস্কফোর্স যখন কাজ শুরু করে (২০২০ সালের আগস্ট মাস), তখন মাত্র ৭৮ হাজার ১০৫টি কোম্পানি এনবিআরের বিভিন্ন কর অঞ্চলে করদাতা হিসেবে নিবন্ধিত ছিল। এর মানে, তখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ কোম্পানি করজালের বাইরে ছিল। রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক এবং লাভ-লোকসান নির্বিশেষে ন্যূনতম কর দেওয়ার কথা থাকলেও করের খাতায় এসব কোম্পানি ছিল নিখোঁজ।
গত বছরের আগস্ট মাসে টাস্কফোর্সের দলটি আরজেএসসি থেকে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর নাম, ঠিকানা, পরিচালকদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এভাবে গত এক বছরে হাজার হাজার নিখোঁজ কোম্পানির সন্ধান পান কর কর্মকর্তারা।
ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানির আর্থিক বছর শেষ হয় ডিসেম্বর মাসে। আর অন্য কোম্পানিগুলোর আর্থিক বছর শেষ হয় জুন মাসে। নিজেদের আর্থিক বছর শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে হয়। সেই হিসাবে, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে খোঁজ পাওয়া এসব কোম্পানিকে রিটার্ন দিতে হবে। এনবিআরের সর্বশেষ হিসাবে, দেশে এখন টিআইএনধারী কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ লাখ ৫৮ হাজার।
কোম্পানির আর্থিক হিসাব-নিকাশ তৈরির ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদেরা। এই হিসাববিদদের অনেকে কোম্পানি সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কেন হাজার হাজার কোম্পানি এত দিন করের বাইরে ছিল—জানতে চাইলে সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংগঠন দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) কাউন্সিল মেম্বার মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এনবিআর ও আরজেএসসির শক্তিশালী নজরদারির অভাবে এত দিন এসব কোম্পানিকে আইন প্রতিপালনে বাধ্য করা যায়নি। এখন এনবিআর নড়েচড়ে বসেছে। তাদের টাস্কফোর্স করের আওতার বাইরে থাকা নতুন নতুন কোম্পানির সন্ধান পাচ্ছে। এসব কোম্পানিকে শুধু টিআইএন দেওয়ার মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। টিআইএন দেওয়ার সময় আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে কি না, নিশ্চিত করতে আইসিএবি ও এনবিআর কাজ করছে।
রিটার্ন দেয় মাত্র ২৮ হাজার কোম্পানি
টিআইএন নেওয়া সব কোম্পানিই যে এত দিন কর দিত, তা নয়। টাস্কফোর্স কাজ শুরু করার আগপর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, টিআইএন নিয়েও এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানি বছর শেষে আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ করে রিটার্ন দিত। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৮ হাজার কোম্পানির টিআইএন ছিল। এর মধ্যে অর্ধলক্ষাধিক কোম্পানি রিটার্ন দেয় না। মাত্র ২৮ হাজার কোম্পানি রিটার্ন দেয়।
আইসিএবি সূত্রে জানা গেছে, আইসিএবির হিসাববিদেরা বছরে মাত্র ১৫ থেকে ১৬ হাজার নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সই করেন। এর মানে, এনবিআরে রিটার্নের সঙ্গে জমা দেওয়া বাকি নিরীক্ষা প্রতিবেদন ভুয়া।
এদিকে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সঠিকভাবে করপোরেট কর আদায় করতে নিরীক্ষা প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংগঠন আইসিএবি নিজেদের ওয়েবসাইটে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমে (ডিভিএস) তাদের সদস্যরা যেসব কোম্পানির নিরীক্ষা করবেন, সেগুলো আপলোড করে দেবেন। কর কর্মকর্তারা সেখানে তা যাচাই-বাছাই করবেন। এতে ভুয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমার প্রবণতা কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কোম্পানি কেন কর দিতে চায় না—এর তিনটি কারণ আছে বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান। যেমন উচ্চ করপোরেট কর হার, হয়রানির ভয় এবং জটিল করব্যবস্থা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করহার বেশি। কোম্পানির মালিকেরা মনে করেন, একবার কর দিলে হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। ভয়ভীতির কারণে তাঁরা আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েও করের পথে হাঁটেন না। কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নেওয়ার পরও বহু কোম্পানি নানা কারণে পরিচালনায় যেতে পারে না। আবার পদে পদে অগ্রিম কর, আগাম ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর দিতে হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কর কেটে ফেলা হয়, যা বছর শেষে করপোরেট কর দেওয়ায় নিরুৎসাহিত করে।