নিউজ ডেস্ক:
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ ঘেঁষা দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর। দুটি শহরই শিল্পসমৃদ্ধ, তবে ঘনবসতিপূর্ণ। যদিও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে যানজট ও পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা শহর দুটির নিত্যসঙ্গী। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জন্য একটি বিস্তৃত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজটি করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। সংস্থাটি ‘প্রিপারেশন অব কম্প্রিহেনসিভ ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান ফর নারায়ণগঞ্জ অ্যান্ড গাজীপুর সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মহাপরিকল্পনা তৈরির জন্য এরই মধ্যে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করেছে ডিটিসিএ।
শীতলক্ষ্যা নদীতীরে গড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জ শহর শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ হাব হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবেও পরিচিত এ শহর। ঘনবসতিপূর্ণ ও শিল্পসমৃদ্ধ এ বন্দরনগরী দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ও যানজটে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। এতে ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম। অন্যদিকে আয়তনের দিক দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুর। প্রায় ৬৫ লাখ জনসংখ্যার এ শহরে দেশের ৭৫ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানার অবস্থান। গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার এক দশক পেরোলেও শহরের যানজট নিরসন ও পরিবহন অবকাঠামো খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর শহরে বড় ধরনের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিটিসিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর শহরের জন্য একটি উন্নত ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং পরিবহন-সম্পর্কিত উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হবে। রাজধানী ঢাকায় যে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন তৈরি হচ্ছে, সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) এগুলোকে শহরের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত করার সুপারিশ রয়েছে। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল উত্তরা-মতিঝিল-কমলাপুরের কাজ শেষ হওয়ার পর লাইনটি গাজীপুরের টঙ্গী পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। অন্যদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে নিউমার্কেট-গুলিস্তান-কমলাপুর-সাইনবোর্ড হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত একটি মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-২) লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। একই সময়ের মধ্যে কমলাপুর থেকে সাইনবোর্ড হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত আরেকটি মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৪) লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। মহাপরিকল্পনায় ঢাকার এসব মেট্রোরেল সম্প্রসারণের বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন ডিটিসিএর কর্মকর্তারা। মেট্রোরেল ছাড়াও নারায়ণগঞ্জে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব, এক্সপ্রেসওয়ে, রিংরোড ও গাজীপুরে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সমীক্ষার কথাও জানিয়েছেন তারা।
মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করেছে ডিটিসিএ। এর মধ্যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, নারায়ণগঞ্জে মেট্রোরেল ও মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ধারণাগত নকশা প্রণয়নের কাজ পেয়েছে এসিই কনসালট্যান্টস লিমিটেড। দরপত্র অনুযায়ী ১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় কাজটি পেয়েছে এসিই কনসালট্যান্টস। অন্যদিকে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি গাজীপুরে একটি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ধারণাগত নকশা প্রণয়নের কাজ পেয়েছে ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেড। এজন্য ১৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা পাবে প্রতিষ্ঠানটি।
ডিটিসিএ বলছে, ২০১৫ সালে ঢাকা ও আশপাশ এলাকাগুলোর জন্য প্রণীত আরএসটিপিতে ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাবের সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে একটি ট্রান্সপোর্ট হাব নারায়ণগঞ্জে করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু আরএসটিপি প্রণয়নের সময় নারায়ণগঞ্জ শহরের ট্রাফিক সার্ভে ডাটাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়নি। ফলে ট্রাফিক চাহিদা নিরূপণ করা যাচ্ছে না। ট্রাফিক চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগের জন্য আলাদাভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্য সম্পাদন সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে মিডল রিংরোড, হাইস্পিড রোড ইত্যাদি মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনাও রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। জনসংখ্যা ও আয়তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নারায়ণগঞ্জ নগরীর জন্য একটি বিস্তৃত পরিবহন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হলে এতে উল্লিখিত সব বিষয় সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিপারেশন অব কম্প্রিহেনসিভ ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান ফর নারায়ণগঞ্জ অ্যান্ড গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রকল্পের পরিচালক মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা নারায়ণগঞ্জে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ধারণাগত নকশা প্রণয়ন করে দেব। এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের জন্য একটি পরিবহন মহাপরিকল্পনা তৈরি করা। ট্রাফিক চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ম্যাস ট্রানজিটের প্রস্তাবিত নেটওয়ার্কের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ধারণাগত নকশা প্রণয়ন করা। ড্যাপ ও আরএসটিপিতে নারায়ণগঞ্জে একটি মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব করার সুপারিশ রয়েছে। এটারও প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ধারণাগত নকশা প্রণয়ন করা হবে। এছাড়া গাজীপুরে একটি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ধারণাগত নকশা প্রণয়ন করা হবে।’
নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর দুটিই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন। দুই সিটি করপোরেশনই ঘনবসতিপূর্ণ। দুটির জন্য যদি এখনই একটি পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা না হয়, তাহলে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে।’
প্রণীতব্য মহাপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরবাসীর জন্য নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।