নাঈমুর রহমান:
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ ছাড়া যাঁদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সারাদেশে তাঁদের মধ্য থেকে ৩৯ হাজার ৯৬১ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে নাটোরের ৮১১ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে। ২০০২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই ৮১১ জন মুক্তিযোদ্ধা জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাঁরা গেজেটভুক্ত হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাটোর জেলার ৮১১ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাই হবে নাটোর সদর উপজেলার। এরপর সিংড়া ও বড়াইগ্রামের ১৪৯ করে ২৯৮ জন, বাগতিপাড়ার ৪ জন, লালপুরের ২৩ জন, গুরুদসাপুরের ৮৬ জন ও নলডাঙ্গার ৯১ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় নাম আসা মুক্তিযোদ্ধাদের কমপক্ষে ৩ জন ভারতীয়/লাল মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত সহযোদ্ধা/সহ প্রশিক্ষণ গ্রহীতার সাক্ষী ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকলে তিনি কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তা ৩ জন ভারতীয়/লাল মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত বীর সহমুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। ভারতীয়/লাল মুক্তিবার্তা তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে এই যাচাই-বাছাই করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই যাচাইয়ের অংশ হিসেবে দেশের ভেতরে প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করার সপক্ষে তিনজন সহযোদ্ধার (ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া) সাক্ষ্য জোগাড় করতে হবে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গেজেট প্রকাশ বা বাতিল বা এর আগে প্রকাশিত বেসামরিক গেজেট বহাল রাখার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হবে।
এদিকে, যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রস্ততকৃত তালিকা প্রকাশের পর কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। নাটোরে যাচাইয়ে প্রেরিত ৮১১ জনের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাসহ পদস্থ ব্যক্তি, অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা।
গত বৃহস্পতিবার নতুন করে আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তা বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৩৩টি প্রমাণের মধ্যে রয়েছে, তাঁরা যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় পড়বেন না।
তাঁদের নাম জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় প্রকাশ হলেও তা যাচাই-বাছাই না করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বেসামরিক গেজেট’ ও ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল’ সুপারিশ করেছে, প্রমাণ পাওয়া গেলে সেসব গেজেট যাচাই-বাছাই না করার জন্য বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি দেশের সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, তালিকা প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তায় নাম আছে, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে ওই যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায়। তাঁদের সনদ কেন আবার যাচাই-বাছাই হবে, তা জানতে চেয়ে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন কেউ কেউ। তবে এই যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপারে নাম প্রকাশ করে কোন মন্তব্য করতে চান না মুক্তিযোদ্ধারা বা প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনরা। তবে এ নিয়ে তাদের ভেতর বেশ চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের যুক্তি, অনেক মুক্তিযোদ্ধার সহযোদ্ধারা জীবিত নেই। ফলে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়নের কেউ নাও থাকতে পারে। এরই সুযোগে এক ধরণের ‘প্রত্যয়ন বাণিজ্য’র সুযোগ পেতে পারে বিশেষ গোষ্ঠী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছেন, এই যাচাই-বাছাই তাদের সামাজিক মর্যাদাকে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মন্ত্রণালয়কে এই কাজে খুব সতর্ক থাকার আহ্বান তাদের।