রবিবার , নভেম্বর ২৪ ২০২৪
নীড় পাতা / ফিচার / নাটোরে করোনাকালের কর্মযজ্ঞ

নাটোরে করোনাকালের কর্মযজ্ঞ

রেজাউল করিম খান, সাংবাদিক কলামিস্টঃ

সংবাদপত্রে খবর লেখা শুরু আশির দশকে। তখন ইত্তেফাকই দেশের প্রধান পত্রিকা। সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে নিজেকে বেশ ক্ষমতাবান ভাবছি। মহকুমা প্রশাসক, এসডিপিও, ওসি, পরে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারগণের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করি। তাঁদের অনেকেই আমাকে স্নেহ করতেন। কিন্তু যৌবনের দুর্বার গতিময়তায় এগিয়ে চলা আমি অন্যায় আর ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনার জন্য অনেকের কাছেই অপ্রিয় হয়েছি। নাটোর মহকুমায় দায়িত্ব পেয়েছি বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী প্রতিষ্ঠার। ফলে প্রশাসকদের প্রশংসা করে খবর লেখা হয় না বললেই চলে। তখন ইত্তেফাকে কয়েক লাইন ভালো কিছু লেখা হলে সকলেই খুশি হতেন। উন্নয়নের সংবাদ লেখা শুরু করি ১৯৮৭ সালে বাংলদেশ টেলিভিশনে নাটোর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর। প্রায় তিন যুগের সাংবাদিকতা জীবনে অনেক দুর্যোগ, সহিংসতা, দুর্ঘটনা, ফসলহানি ও মারী-মড়কের খবর লিখেছি। রাজনীতিক, প্রশাসন, সেনা বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব- সকলেই বিপর্য়য়ের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরাও ছুটেছি গ্রাম-শহরের আনাচে কানাচে। সেই সময়ে বিপদকে বিবেচনায় না নিয়ে সংগ্রহ করা খবরগুলি পত্রিকার পাতায় দেখে খুশিতে ভরে উঠতো মন। উত্তেজনা ছিল, ছিল রোমাঞ্চ। কিন্তু এবারে মৃত্যুর বার্তাবাহক করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর অতীতের সবকিছুকেই ম্লান করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ এক মহাবিপর্যয়। এর মধ্যেই যাঁরা আক্রান্তের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের কুর্ণিশ জানাই। দেশের অনেকই হয়তো করোনাকালের এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু নাটোরের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজের গ্রাম-জনপদে ছুটে চলার যে দৃশ্য ফেসবুকে দেখেছি, তার তুলনা বিরল। দেশে করোনা বিষয়ক করণীয় ঘোষণার পরই জেলা প্রশাসক ৮ মার্চ লিফলেট বিতরণের জন্য রাস্তায় নামেন। যার শিরোনাম ছিলো, “করোনা প্রতিরোধে আতংকিত না হয়ে আমাদের করনীয়।” পরদিন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির আলোচনা সভা। বিষয়, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে আতংকিত না হয়ে আমরা সবাই সচেতন থাকবো।’ ১৬ মার্চ বিদেশ থেকে আগত সকল ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইন এ থাকার জন্য অনুরোধ করেন। ১৯ মার্চ চাল,ডালসহ নিত্যপন্যের বাজার স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভা এবং কেউ যেন নিত্যপন্যের বাড়তি দাম আদায় করতে না পারে সে লক্ষ্যে বাজার মনিটরিং করা হয়। ২৪ মার্চ নাটোর জেলার সকল বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের সার্বক্ষণিক হাসপাতাল ও ক্লিনিক খোলা রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ২৬ মার্চ নাটোর জেলায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবক হতে চাইলে ফরম পূরণের অনুরোধ করা হয়। ৩১ মার্চ বাস, মিনিবাস, দোকানদার, রেষ্টুরেন্ট, কাভার্ডভ্যান, ঔষধ ব্যবসায়ীসহ সকল মালিক সমিতির সদস্যকে সরকার ঘোষিত বন্ধকালীন সময়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের প্রাপ্য বেতন পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। ৩১ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক প্রতি ইঞ্চি জমির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এইসব সরকারি নির্দেশনা প্রচারের ফলে নাটোরের মানুষ সচেতন হতে থাকে ও সংক্রমণ কম হয়। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় কর্মহীন দরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ।

জেলা প্রশাসক তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ক্লান্তিহীন ছুটে চলেন। তিনি দিনমজুর, ডেকোরেটর শ্রমিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, রিক্সা চালক, মোটর শ্রমিক, দুঃস্থ মহিলা, হোটেল শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, প্রতিবন্ধী শিশু, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, মন্দিরের পুরোহিত, গ্রাম পুলিশ ও করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে খাদ্য ও উপহার সামগ্রী পৌঁছে দেয়া হয়।

এছাড়া জেলা প্রশাসক কওমী মাদ্রাসার এতিম, দুঃস্থ ও অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা অনুদানের চেক বিতরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক জেলার ৩০৩২ টি মসজিদের অনুকূলে ৫০০০/ টাকা হিসেবে ১৫১৬০০০০/ টাকা অনুদান প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই কথা হৃদয়ে ধারণ করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ পিএএ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, যারা নিজেদের কষ্টের কথা লজ্জায় অন্যের কাছে বলতে পারছেন না, তাদের জন্য মোবাইল ফোনে কল পেয়ে বাড়িতে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের মধ্যে হয়তো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, কিন্তু তাঁর আন্তরিকতার কোনও অভাব ছিল নাা।

এই দুঃসময়ে তাঁর পাশে ছিলেন পুলিশ সুপার লিটন সাহা, এডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, সহকারী কমিশনার, কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিগণ। এরই মধ্যে জেলায় সফলভাবে বোরো ধান কাটা শেষ হলে সরকারি গুদামে ধান ক্রয়ও উদ্বোধন করেন।

অতঃপর নাটোরের মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, “এ নীরবতা, নীরবতা ভাঙ্গার জন্য। এ স্তব্ধতা ভবিষ্যতের কোলাহলকে আলিঙ্গন করার জন্য।”

আরও দেখুন

অতিরিক্ত ভালোবাসা ঠিক নয়

নজরুল ইসলাম তোফা: আমরা জীবনে চলার পথে বহু মানুষকে “ভালোবাসা” দিয়ে দিয়ে থাকি। হয়তো আমরা …