নিজস্ব প্রতিবেদক, বড়াইগ্রামঃ
বৈচিত্রময় নাটোরের কৃষিতে সংযোজন ঘটেছে ভাসমান সবজি চাষের । নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কৃষকরা নদী আর বিলের পানিতে কচুরিপানার বেড তৈরি করে সবজি চাষ করছেন । কীটনাশকের ব্যবহার নেই বলে উৎপাদিত সবজি নিরাপদ । আবাদি জমি কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জলাধারের এই সবজি চাষ কৃষি উৎপাদনের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায় , ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা , সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার বাটরা, বাঘইট, মেরিগাছা, ধানাইদহ, তারানগর গ্রামে বয়ে যাওয়া নারদ ও খলীসাডাঙ্গা নদী এবং চিনি ডাঙার বিলে কচুরিপানা ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে ভাসমান বেড । এসব গ্রামের ৩১ জন কৃষক শতাধিক বেডে উৎপাদন করছেন লালশাক, কলমি শাক, পালং শাক, কলা শসা । কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, ও প্রযুক্তি সহযোগিতা প্রদান করছে কৃষি দপ্তর । পাশাপাশি প্রদর্শনীর বেড স্থাপন এবং মাঠ দিবসের মাধ্যমেও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে কৃষকদের।
উপজেলার নগর ইউনিয়নের বাটরা গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ চিনি ডাঙ্গার বিলের জমিতে কচুরিপানা দিয়ে আটটি বেড তৈরি করেছেন । সেখানে লাল শাক, গীমা কলমী, লাউ ও শসার চাষ করছেন তার পাশে আব্দুল বারী, রাশেদুল ইসলাম, ফিরোজুর রহমানসহ ৭ জন কৃষক একই সবজি আবাদ করেছেন । ও শসা চাষের জন্য তারা বিলের মধ্যে মাচা তৈরিও করেছেন ।
কৃষক আবদুল মজিদ বলেন, ভাসমান বেডে সবজি চাষ খুবই লাভজনক । বেডে প্রাকৃতিক উপাদানে জৈবিক সক্ষমতা অনেক বেশি থাকে । কোন প্রকার সার প্রয়োজন হয় না বললেই চলে আর কীটনাশক ব্যবহার করতেই হয় না । আবার যে জমিতে সবজির চাষ করা হচ্ছে, জলাবদ্ধতা ও কচুরিপানার কারণে সেখানে কোন ফসল হতো না । একএসব জমিতে পানি শুকিয়ে গেলে শুধু বোরো ধান আবাদ হয়ে আসছিল । এখন অক্টোবর থেকে জানুয়ারি এসব জলাধার ব্যবহার করে তারা শীতকালীন সবজি চাষ করতে পারছেন । কৃষক আব্দুল বারী জানান চলতি বছর তার এক বিঘা জমিতে ভাসমান বেডে করে সবজি চাষ করেছেন । ইতিমধ্যে সবজি বিক্রি করে প্রায় লক্ষ টাকা আয় হয়েছে । এসব বেডে সবজি চাষে পোকামাকড়ের আক্রমণ নেই, আগাছারও আধিক্য নেই ।
আবাদ শেষ হয়ে গেলে কচুরিপানার বেড উন্নত মানের জৈব সার হিসেবে তারা বোরো ধান আবাদে ব্যবহার করবেন বলে জানিয়েছেন কৃষক রাশেদুল ইসলাম । তিনি বলেন, নতুন এই চাষাবাদ পদ্ধতি দেখতে ও চাষাবাদের খোঁজখবর নিতে প্রায় প্রতিদিন আশেপাশের কৃষকরা ভাসমান বেড এলাকায় ভিড় করছেন ।
উপজেলা কৃষি অফিস ভাসমান সবজি চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ছাড়াও বেড নেট , সবজি বীজ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রদান করছে । প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে কৃষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়াও সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কৃষকদের অংশগ্রহণে বাটরা মাঠের আয়োজন করা হয়। মাঠ দিবস ভাসমান সবজি চাষের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পেয়ে উপকৃত হয়েছেন অংশগ্রহণকারী কৃষকরা । তারা জানিয়েছেন, আগামী মৌসুমে তাদের বাড়ির পাশের জলাধারে বেডে সবজি চাষ করবেন । এতে করে আশা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে ভাসমান বেডে আবাদের পরিধি বাড়বে ।
উপজেলায় তথা সমগ্র জেলায় নতুন এই চাষাবাদ পদ্ধতির সাথে কৃষকদের মেলবন্ধন তৈরি করে দিয়েছেন উপজেলা কৃষি অফিসার ইকবাল আহমেদ । কৃষি অফিসার বলেন, ভাসমান বেডে সবজি চাষ লাভজনক । আবার বিশ মুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য ও জলবায়ুর জন্য উপকারী। যে সকল স্থানে সবজি চাষ হচ্ছে সেখানে কচুরিপানা জলাবদ্ধতার কারণে কৃষক কোনদিন এসব জলাধার ব্যবহার করতে পারতেন না । ভাসমান বেড তৈরিতে কচুরিপানা ব্যবহার করা হচ্ছে । এই কচুরিপানা পরবর্তীতে জৈবসারে পরিণত হচ্ছে । আবার জলাবদ্ধতার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে না । জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মনোনীত দেশের কৃষিতে একমাত্র “বিশ্ব ঐতিহ্য”- এই চাষাবাদ পদ্ধতি একসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে আশাবাদী এই কৃষিবিদ ।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ডক্টর রবিআহ নূর আহমেদ বলেছেন, বড়াইগ্রামে ভাসমান বেডে সবজি চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । অন্যান্য উপজেলায় বিশেষ করে চলনবিল ও হালতিবিল এলাকায় এই চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কাজ করবে।