করোনা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা সামগ্রিক গা-ছাড়া ভাব আছে। যখন পৃথিবীর অনেক দেশ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে লকডাউনের দিকে গেছে, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং (পরস্পর কম পক্ষে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা) কার্যকর করেছে, তখন আমরা আস্তে ধীরে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে গেছি। আমাদের দেশে ৪ জনের মৃত্যু এবং অন্তত ডিন ডজন ব্যক্তির আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা কিছুটা নড়চড় শুরু করেছি। এরপর যা করা হলো, সেটাও একটা ঢিলেঢালা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয়ভাবে লকডাউন, জরুরি অবস্থা বা কারফিউ না, ঘোষণা করা হলো ১০দিনের সাধারণ ছুটি। এই ঘোষণাও দেয়া হলো ছুটি শুরু হওয়ার ৪ দিন আগে। এই ছুটির খবর পেয়ে সবাই দল বেধে গাদাগাদি করে ঘরে ফেরার অভিযানে সামিল হলো। গণপরিবহন বন্ধ করা হলো ঠিকই, ততদিনে একে-অপরের সঙ্গে নিঃশ্বাসের ভাগাভাগি করে যার যার ঠিকানায় ঠিকই পৌঁছে গেল!
করোনা নিয়ে উদাসীনতা অবশ্য প্রথম থেকেই লক্ষ করা গেছে। চীনে করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হয় গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে। আর আমাদের দেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু হয় ২১ জানুয়ারি৷ স্ক্রিনিংয়ের শুরুতে শুধু চীন থেকে আসা যাত্রীদেরই এর আওতায় নেয়া হয়৷ পরে অবশ্য অন্য সব যাত্রীকেও নেয়া হয়।
২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৫৫ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ৬ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৩ জন প্রবাসী ও বাংলাদেশি বাসিন্দা। করোনার মহামারির মধ্যে তাদের ২ হাজার ৫১৮ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই নিয়ম অমান্য করেছেন। দেশের বিভিন্নস্থানে অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
একথা সবাই মানবেন যে, করোনাভাইরাস কোনো না কোনো বিদেশ-ফেরত ব্যক্তির মাধ্যমেই আমাদের দেশে এসেছে। দরকার ছিল তাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা। বোঝানো, কেন তাদের কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া দরকার। কিন্তু সরকার তা করেনি। আসলে করোনার বিপদ নিয়ে সরকার সিরিয়াস হয়নি। অন্যরাও হয়নি।
ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। চীনের পর একে একে ইতালি, স্পেন, ইরান, জার্মানি, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলিকে ক্ষতবিক্ষত করে করোনা এবার থাবা বসাতে শুরু করেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। করোনার তাণ্ডবলীলায় উন্নত দেশগুলির বেসামাল অবস্থা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। করোনাকে সামাল দিতে সম্পদশালী ও চিকিৎসা পরিকাঠামোর শীর্ষে থাকা দেশগুলিরই ল্যাজেগোবরে অবস্থা। তা দেখে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলি প্রবল চাপের মুখে। বাংলাদেশে এই সঙ্কট আরও গভীর। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি গরিব দেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যাকে করোনার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করা অনেক বড় এবং কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। প্রতিষেধকহীন এই মারাত্মক ভাইরাস মোকাবিলার একটাই অস্ত্র, আত্মরক্ষা। আলাদা থাকা, একা থাকা, ঘরে থাকা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বে এগিয়ে থাকা এবং অত্যন্ত কম জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতালি, স্পেন, আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইংল্যান্ড করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় নাকানিচোবানি খাচ্ছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ করোনাকে ছোট করে দেখা এবং অবশ্যই তাদের জীবনযাত্রা। হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ওই সমস্ত দেশ এই মুহূর্তে করোনা আক্রমণের স্টেজ থ্রি ও ফোর দশায় অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিকে এই খেসারত হয়তো দিতে হতো না।
আমাদের দেশে এই আক্রমণ কিছুটা পরে শুরু হওয়ায় আমাদের সামনে এখনও একটা সুযোগ রয়েছে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনা স্টেজ টু পর্বে রয়েছে। এখনও ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ শুরু হয়নি বলেই অনুমান। এখনও পর্যন্ত যাঁরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় আইসোলেশনে রয়েছেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই সুনির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা হয় বিদেশে আক্রান্ত হয়ে এদেশে এসেছেন অথবা আক্রান্তদের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে এসেছেন। কিন্তু, তৃতীয় স্টেজটাই ভয়ঙ্কর। মানুষ নিজের অজান্তেই এই ভাইরাসের শিকার হবেন এবং অন্যকেও বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন। তাই সতর্ক না হলে দেশজুড়ে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
বিজ্ঞাপন
করোনাভাইরাসের সঠিক মোকাবিলা করতে হলে আপাতত ‘গৃহবন্দি’ হয়ে থাকা আবশ্যক। যাদের বাইরে যাওয়া অনিবার্য তাদেরও সতর্ক হওয়া দরকার। অন্তত মুখে মাস্ক পরা, প্রতি দুজন মানুষের মধ্যে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা দরকার।
সারাবিশ্বই বর্তমানে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকারকানা অফিস
বন্ধ। অনেক অফিস অনলাইনে চলছে। অনেক অফিস যেটুকু কাজ না করলে নয়, তা-ই
করছে। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় শহরগুলো গত দুই সপ্তাহ ধরে স্তব্ধ, শূন্য
প্রান্তরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাণের স্পন্দন নেই। যান নেই, জন নেই।
এ রকম কত দিন চলবে? কেউ জানেন না। আশাবাদীরা বলছেন তিন-চার মাস। আবার এমন
ভীতিপ্রদ হিসেবও পড়েছি, যা বলছে অন্তত দেড় বছর। এমন সঙ্কট আমরা অতীতে
দেখিনি। পরিচিত অনেকের মনেই এক সাধারণ উৎকণ্ঠা: এই সঙ্কট যত গভীর হবে,
সমাজের চেহারাটা ততই কি বদলাবে? কী ভাবে? বেশির ভাগ মানুষের জীবন
অনিশ্চয়তার ঘুরপাকে ফেলে দিয়ে তো আর কোনও সমাজ স্থিতিশীল থাকতে পারে না।
প্রচুর মানুষের এখন আয় নেই বা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যারা দিনে এনে দিন খান,
তারা কীভাবে বেঁচে থাকবে? এই মানুষেরা যদি কেড়ে খেতে শুরু করে কখন কী হবে?
ধনতান্ত্রিক সমাজে সাধারণত অসুখবিসুখ বাজারি ব্যবস্থার মাধ্যমে মোকাবিলা করা হয়। স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা মানে শুধু রোগমুক্তি নয়, স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের মুনাফাও বটে। কিন্তু করোনাভাইরাস ধনতান্ত্রিক দেশগুলোকেও সে সুযোগ দেয়নি। এই মহামারিতে বরং ধনতান্ত্রিক সমাজই যেন উরুতে ঘা খেয়ে পা ভেঙে বসে পড়েছে! আমাদের কী হবে, সেটা ভাবলে শরীর হিম হয়ে যায়! আপাতত ঘরে থাকা এবং সব ধরনের জনসমাগম এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন থাকার নীতি অবলম্বন করে সব দেশ পরিত্রাণ খুঁজছে। আমাদেরও এই নীতি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান পরিস্থিতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া, সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করা। একই সঙ্গে আরও কঠিন সময়ের জন্য মানসিকভাবে তৈরি করার ঘোষণাও দরকার। একথা ঠিক যে প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে কোনো সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই যে যথেষ্ট নয়। সরকারের সীমাবদ্ধতার কথাও জানাতে হবে। গত ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা কিন্তু আশ্বস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বিত্তশালী আমেরিকা বা ইউরোপই যেখানে সংক্রমণ সামাল দিতে নাজেহাল, সেখানে বাংলাদেশের ক্ষমতা আর কতটুকু? কিন্তু সদিচ্ছাটুকু অন্তত জানানো দরকার ছিল। বোঝানো দরকার ছিল, সামান্য, সীমিত সামর্থ্য নিয়েই লড়ে যেতে তিনি তৈরি। তিনি সরকারি-বেসরকারি সকল স্বাস্থ্য প্রদানকারী সংস্থাকে একজায়গায় ‘মানবিক’ দৃষ্টিতে সেবা প্রদানের আবেদন জানাতে পারতেন। সরকারি–বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগ কীভাবে জনহিতে কাজে লাগানো যেতে পারে-সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন। যাহোক, সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সরকারকে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাব ও ফলাফল নিয়ে এখনই গভীরভাবে ভাবতে হবে। করোনাভাইরাস-জাত আর্থিক সমস্যার শাকে সরকার অর্থনীতির গভীর স্বাস্থ্যভঙ্গের বিপদটিকে যেন আড়াল করতে না চায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কর্তব্য, সেটা যদি সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা না জানেন, তবে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু, কিছুই হয়নি, আমরাই সব সামলাতে পারব, এমন মিথ্যা অহঙ্কারের হাতে দেশকে ছেড়ে দিলে মহাবিপর্যয় গ্রাস করবে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন: এত দেরি কেন? প্রতিরোধক ব্যবস্থাই বা এত ঢিলেঢালা কেন? আবার দেশের জনসংখ্যা এবং সংক্রমণের অনুপাত হিসাব করে অনেকেই বলছেন, আমাদের জন্য দুঃচিন্তার এত কারণ নেই। ক্ষোভ, অভিযোগ, তর্ক— অতি উৎকৃষ্ট বস্তু। কিন্তু এখন এসব চর্চার সময় নয়। বিপদ কাটলে তর্ক করবার, অনুপাত কষবার বিস্তর অবকাশ মিলবে। যাতে বাধ্য হয়ে জনজীবন অচল করতে না হয়, সেই কারণেই জনসমাগম ও সামাজিক মেলামেশা যথাসম্ভব কমানো জরুরি। এখনও পর্যন্ত যে পরিস্থিতি রয়েছে, সেটাকে ধরে রাখার জন্য চাই আরও সতর্কতা ও নিরলস প্রচেষ্টা।
বিশ্বের বিখ্যাত সব সাহিত্যিক-অ্যালবেয়ার ক্যামু, জ্যাক লন্ডন, মার্কেজ প্রমুখের লেখায় মহামারীর বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের ছবি আঁকা হয়েছে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি/ বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টিকা পরি।’ মানুষের কপালে আছে অমৃতের টিকা। তার ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়।’ এই জয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনতে সরকার ও দেশের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে।