নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর শাহজাহানপুরের ঝিল মসজিদের পশ্চিমে একটি ঝুপড়িতে বসবাস করেন গৃহকর্মী জাহানারা বেগম (ছদ্মনাম)। রিকশাচালক স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বড় মেয়েটি খিলগাঁওয়ের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ের বয়স সাড়ে চার বছর। কষ্ট হলেও তাদের চারজনের সংসার ভালোই চলছিল। করোনার প্রথম দফায় কঠোর বিধিনিষেধে (লকডাউন) বন্ধ হয়ে যায় তাদের আয়-রোজগার। রিকশার আয় বন্ধের পাশাপাশি সব বাসা থেকে গৃহকর্মীর কাজও হারান জাহানারা। সরকারি ত্রাণ পেতে স্থানীয় নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। তবে ত্রাণ তো পানইনি, উল্টো তালিকায় নাম ওঠাতে তার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন স্থানীয় নেতারা। এটি শুধু রাজধানীর শাজাহানপুরের চিত্র নয়, সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎ, বিতরণে স্বজনপ্রীতি ও ত্রাণের তালিকায় নাম ওঠাতে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ ছিল দেশের নানা প্রান্ত থেকে। এমন অভিযোগে গত দুই বছরে বরখাস্তও হয়েছেন শতাধিক জনপ্রতিনিধি। এমনকি ঘুষ চাওয়ার অপরাধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছেন অনেকে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎ ও বিতরণে স্বজনপ্রীতি রোধ এবং ত্রাণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে সারা দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষের একটি তালিকা তৈরি করতে যাচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তালিকা অনুযায়ী এসব মানুষকে দেওয়া হবে মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ কার্ড। স¥াট কার্ডের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চালসহ খাদ্য সহযোগিতা এবং নগদ অর্থ সহায়তা দেবে সরকার। এ জন্য নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের তালিকা (ডেটাবেজ) তৈরি করবে সরকার। তালিকাভুক্ত প্রতিটি মানুষকে দেওয়া হবে ইউনিক আইডি (স্মার্ট কার্ড)। যেখানে থাকবে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মনিবন্ধন নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর, পরিবারের জনসংখ্যা, সহায়-সম্পদ ও আয়-ব্যয়সহ সব ধরনের তথ্য। সরকারি যে কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা নিতে হলে তাকে ওই স্মাটকার্ড ত্রাণ বিতরণকারীদের কাছে থাকা যন্ত্রে পাঞ্চ (সংযোগ) করতে হবে। অথবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হবে নগদ অর্থসহায়তা। তবে যে মাধ্যমেই সহায়তা দেওয়া হোক না কেন ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা গ্রহণকারী মানুষের সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করবে সরকার। উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান নিজ দফতরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎ ও বিতরণে স্বজনপ্রীতি রোধ এবং ত্রাণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি করা হবে। তাদের বিভিন্ন তথ্য সংকলিত স¥ার্ট কার্ড দেওয়া হবে। এটি কার্যকর হলে ওই কার্ড ছাড়া কেউ সরকারি ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারবে না। নগদ অর্থ দেওয়া হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হবে। কে কতবার সরকারি সহায়তা গ্রহণ করেছে তার হিসাব থাকবে সরকারের কাছে। ফলে ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।’ দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকার অসহায় মানুষদের তালিকা প্রস্তুত করেছেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা। উপজেলাগুলো তালিকা নিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর কাছ থেকে। পৌরসভার কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। অর্থাৎ তালিকাটি তৈরি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর ও মেয়ররা। মানবিক সহায়তা কার্ডে অন্তর্ভুক্তির জন্য অসহায় ব্যক্তি বা পরিবারের প্রধানের নাম, জন্ম তারিখ, সেলফোন নম্বর, বর্তমান ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং আগে কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ছিল কি না- এসব তথ্য পাঠানো হয়েছে মাঠ পর্যায় থেকে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বের হয়ে করোনায় কর্মহীন মানুষের তালিকা করতে বলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো কোটা দেওয়া হয়নি। স্থানীয় কমিটি তালিকাটি তৈরি করেছে। কার্যক্রমে স্বচ্ছতার জন্য কমিটিতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মসজিদের ইমামকে যুক্ত করা হয়েছে।