শনিবার , নভেম্বর ১৬ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / নতুন জীবনে খুশি রোহিঙ্গারা

নতুন জীবনে খুশি রোহিঙ্গারা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভাসানচরে অস্থায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসে নতুন জীবন পেয়েছেন ১৬৪২ জন রোহিঙ্গা। শনিবার সকাল থেকেই সংসার সাজানোয় ব্যস্ত গৃহিণীরা। খেলায় মেতে উঠেছে শিশুরা। পরিবারের কর্তারা দিনভর ব্যস্ত ছিলেন কাজে-গল্পে-আড্ডায়। এখানে রোহিঙ্গাদের একটি আঞ্চলিক অনুষ্ঠান মোরগ-মুরগির বিয়ের আয়োজনও করা হয়।

নিশ্চিত নিরাপত্তা ও সুরক্ষিত ঘরে রাত কাটিয়ে সকাল থেকে সবাই ছিলেন ফুরফুরে মেজাজে। সামান্য কথাতেই হাসির শব্দে খুশির রেশ ছড়িয়ে পড়ে নতুন ঠিকানায়। অনেকেই সকাল থেকে ফোনালাপে কক্সবাজারে ফেলে আসা পরিবারের অপর সদস্যদের খোঁজ নেন। তাদের এখানে চলে আসার আহ্বান জানান। বর্ণনা দেন তারা কি পেয়েছেন, আর কি পাবেন। তুলনা করে বুঝিয়ে দেন ফেলে আসা শিবিরের চেয়ে অনেক ভালো জায়গায় তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তারা আগের চেয়ে ভালো আছেন। অন্যরা এলেও যে ভালো থাকবেন তা বলতে ভুলছেন না।

শুক্রবার নৌবাহিনীর সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হয় ১৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে। এদিন দুপুরের দিকে স্বেচ্ছায় এই অস্থায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসে পৌঁছায় প্রথম দলটি। এরপর থেকে শনিবার পর্যন্ত কাউকে রান্না করতে হয়নি। প্রতি বেলায় তাদের খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। আগামী আরও এক-দু’দিন এভাবেই চলবে। এরপর থেকে নিজেদের রান্না করতে হবে। প্রথম দিন রান্নার ঝামেলা না থাকায় নারীদের ঘর গোছানো ছাড়া কাজও নেই। তাই গল্প-আড্ডা আর পান খেয়েই কেটেছে তাদের সারাবেলা। সবারই মুখে প্রায় অভিন্ন কথা- তা হল এমন জীবন তারা কেউ আশাই করেননি। যা পেয়েছেন তা স্বপ্নাতীত। সব মিলে নতুন জায়গা পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা। পাশাপাশি তাদের এই আধুনিক মানের বসবাস দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে তারা প্রশংসা করেছেন।

এদিকে ভাসানচরে একটি আইসোলেশন সেন্টার আছে। হালকা ঠাণ্ডা-জ্বর বা এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলেই রোগীকে আইসোলেশনে নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি সাত দিনের মধ্যে এখানে করোনার নমুনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন করা হবে। যাতে নমুনা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এখানেই পরীক্ষা করা যায়। এছাড়া চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, নার্স, হাসাপাতাল সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।

এত সব পেয়েও স্বেচ্ছায় আসা রোহিঙ্গাদের একটাই চাওয়া তা হল, খুব শিগগিরই যেন তারা নাগরিক হিসেবে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেন। এজন্য তারা বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানান।

ভাসানচরে রোহিঙ্গা অস্থায়ী আবাসন প্রকল্পের নতুন ঠিকানায় এসেছেন অলিউল্লাহ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এখানে আসার আগে একটি মহল আমাদের ভয় দেখিয়েছিল। তারা বলেছিল, ভাসানচরে এনে বাংলাদেশ সরকার আমাদের পানিতে ফেলে দেবে। এছাড়া সেখানে কুমির ও ভয়ানক জীবজন্তু আছে। তারা রাতের আঁধারে আমাদের খেয়ে ফেলবে। কিন্তু এখানে এসে এক রাত কাটিয়ে এমন কিছুই দেখছি না। বরং বাংলাদেশ সরকার আমাদের কক্সবাজেরর চেয়েও ভালো আবাসন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। খাবার দিচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল করেছেন। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালও আছে। সর্বোপরি এখানে আমাদের অনেক ভালো লাগছে। তাই কক্সবাজারে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজনদের সকাল থেকেই ফোন করছি। এখানের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছি। তারাও চলে আসবেন। তিনি বলেন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দেই সময় কাটছে।

বালুখালী ১৭নং ক্যাম্প থেকে এসেছেন আবদুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্প কক্সবাজার ক্যাম্পের চেয়ে অনেক ভালো। সেখানে পলিথিন দিয়ে ঘেরাও করা ঘর ছিল। এখানে আমাদের জন্য পাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে। দেখে আধুনিক শহর মনে হচ্ছে। কক্সবাজার রোহিঙ্গ ক্যাম্পে পরিবার নিয়ে থাকতে ভয় হতো। সেখানে নিরাপত্তা থাকলেও ভাসানচরে অনেক বেশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে খোলামেলা জায়গা পেয়ে খেলাধুলায় মগ্ন। সবকিছুতে যেন একটি শান্তির পরশ ছুয়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা শিশু নাসরিন (১০) বলেন, নতুন জায়গাটা অনেক সুন্দর। আমাদের এখানে অনেক ভালো লেগেছে। খাবারও দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে একটি চিপসও খেয়েছি। এখানে কয়েকজন মিলে আমরা দরিলাফ খেলছি। কিছুক্ষণ আগে খেলেছি বউ-পুতুল।

জানতে চাইলে ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, নতুন জায়গায় এসে তারা যে কি পরিমাণে আনন্দ উল্লাস করছে। তবে তাদের আরও ভালো রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ আগে থেকেই নেয়া হয়েছে। তা এখন সুপরিকল্পিতভাবে অ্যাপলাই করছি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত পরিকল্পিত অস্থায়ী আবাসন প্রকল্প। ব্রিটিশ কোম্পানির ডিজাইনে শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এছাড়া দ্বীপের চারদিকে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন। সাগরের মাঝে গড়ে ওঠা নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং পরিবেশসম্মত এই নগরীতে একসঙ্গে এক লাখ মানুষ থাকতে পারবে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। এই মেগা প্রকল্পটি নির্মাণ, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রশাসনিক বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নজরদারি করছে। বাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে এখানে আসা রোহিঙ্গারা ভালো থাকতে পারে।

এদিকে তুলনামূলক হিসেবে দেখা গেছে, কক্সবাজারের চেয়ে ১৮টি উন্নত সেবা রয়েছে এখানে। কক্সবাজারে ২০ জনের জন্য ১ টয়লেট এবং ৮০ জনের জন্য ১ গোসল খানা, কিন্তু ভাসানচরে ১১ জনের জন্য একটি টয়লেট ও ১৬ জনের জন্য ১ গোসলখানা। কক্সবাজারে খাদ্যগুদাম নেই, সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো নয়, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে খাদ্য পৌঁছাতে হয়। কিন্তু ভাসানচরে খাদ্য সংরক্ষণে ৪টি উন্নত ওয়্যারহাউস রয়েছে। যেখানে ১ লাখ মানুষের ৩ মাসের খাবার মজুদ ও উন্নত পরিবেশ নিশ্চিতের ব্যবস্থা রয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের বেশির ভাগ এলাকাই যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। আর ভাসানচরে ডিজেল জেনারেটর, সৌরবিদ্যুৎ এবং সৌরশক্তির মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা রয়েছে। কক্সবাজারে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই।

পাশাপাশি ভাসানচরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কক্সবাজারে অধিক জনবল এবং বসবাসের অনুপযোগী। বিপরীতে ভাসানচরে উন্নত পরিবেশ, তুলনামূলকভাবে কম জনসংখ্যা। কক্সবাজারে উচ্চ বনাঞ্চল, জৈব-বৈচিত্র্যের অবক্ষয়, উচ্চ বায়ুদূষণ, মাটির ক্ষয়, ভূমিধস এবং পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা সুযোগ রয়েছে। বিপরীতে ভাসানচরে বনায়নের বিশাল সুযোগ, মাটির ক্ষয় হবে না এবং ভূগর্ভস্থ পানি নিচে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। কক্সবাজারে যানজট, সড়ক যোগাযোগ সীমিত, রাস্তা নির্মাণ ব্যয়বহুল এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন। কিন্তু ভাসানচরে পরিকল্পিত রাস্তা, যানবাহনের সুবিধা এবং উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা আছে। কক্সবাজারে ভূমিধস ও ঘূর্ণিঝড়কালীন ঝুঁকি রয়েছে। ভাসানচরে ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার থাকায় ঝুঁকি কম। কক্সবাজারে পর্যটনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভাসানচরে সে ধরনের কোনো প্রভাব নেই। কক্সবাজারে প্রায় মানব ও মাদক পাচার ধরা পড়ছে। কিন্তু ভাসানচরে মানব ও মাদক পাচারের দিক থেকে সুরক্ষিত ভাসানচর এবং সেখানে আগুনের ঝুঁকি নেই। কক্সবাজারে ব্যবস্থাপনা বিশৃঙ্খলা কিন্তু ভাসানচরে সংগঠিত। কক্সবাজারের রান্না কাঠ-কয়লার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভাসানচরে বায়োগ্যাস এবং প্যান্টের সঙ্গে পরিবেশবান্ধব চুলা রয়েছে।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা যুগান্তরকে বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা অনেক ভালো থাকবে। তারা একদিন কাটিয়েই তাদের মনোভাব আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। এখানে তাদের জন্য সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যা তাদের কল্পনাতেও ছিল না। তিনি বলেন, শনিবার পর্যন্ত এখানে ২০০ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ আছে। আমরা তাদের রান্না করে খাবার দেয়ার পাশাপাশি কম্বল ও ঘরে অন্যান্য সামগ্রী দিয়েছি। কয়েকদিনের মধ্যে তাদের এলপিজি গ্যাস ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তখন তারা নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবে। তবে চাল থেকে শুরু করে অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী আমরাই দেব। এজন্য ১২৩২টি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার আনা হয়েছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতি হাউসে ৮টি করে ১৬টি সিলিন্ডার দেয়া হবে। যাতে তারা নির্বিঘ্নে রান্নার কাজ করতে পারে। কারও সঙ্গে কারও সমস্যা না হয়।

অস্থায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে এনজিও অ্যালায়েন্স অব ভাসানচরের কো-অর্ডিনেটর সাইফুল ইসলাম কলিম যুগান্তরকে বলেন, এখানে ২২টি এনজিও কাজ করছে। তারা নৌবাহিনীর সহায়তায় সকাল থেকেই নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। চারটি ক্লাস্টারে রান্না করা খাদ্যসামগ্রী দেয়া হচ্ছে। যার যা প্রয়োজন তা পূরণ করা হচ্ছে। তাদের নানা ধরনের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড শেখাচ্ছেন। এছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও কাজ করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, এই অস্থায়ী আবাসন প্রকল্পে নৌবাহিনীর একটি মেডিকেল টিমসহ নোয়াখালীর সিভিল সার্জন অফিস কাজ করছে। নোয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসের হেলথ কো-অর্ডিনেটর ডা. মাহতাব উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এখানে জরুরি ও স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে নৌবাহিনীর সহায়তায় করা হচ্ছে। নৌবাহিনীর কাছ থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত হাসপাতাল গত ২ তারিখ আমরা বুঝে পেয়েছি। জরুরি রোগীদের জন্য নৌবাহিনী টিমের মাধ্যমে নৌ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে নোয়াখালী ২৪০ শয্যার হাসপাতালে স্থানান্তর সহজ হবে। পাশাপাশি বিমানবাহিনীর এই কার্যক্রমেও সহায়তা করবে।

জানা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে ২০১৭ সালে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরা কক্সবাজার এবং টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন শুধুই তাদের সেখানে পাঠানো হয়েছে।

আরও দেখুন

নন্দীগ্রামে রস সংগ্রহের জন্য খেজুরগাছ প্রস্তুত 

নিজস্ব প্রতিবেদক নন্দীগ্রাম ,,,,,,,,,,বগুড়ার নন্দীগ্রামে রস সংগ্রহের জন্য খেজুরগাছ প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন হেমন্তকাল। মাঠ …