অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের দিক থেকে দেশটিকে ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয়, মাথাপিছু উৎপাদন, শিল্পোন্নয়ন, সরকারের স্থিতিশীলতা, জ্বালানি ব্যবহার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং উন্নয়নের বহু সূচকে এখন বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পাকিস্তান।
বাংলাদেশকে গত কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমের অর্থনীতিবিদরা বিশ্বের বিস্ময় বলছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছিলেন বিশ্বের বরেণ্য অর্থনীতিবিদরা। তাদের আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশ তার বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবারের সংস্থানটি করতে পারবে না। কিন্তু তারা যে জনসংখ্যা দেখে এই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন, সেই জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় আড়াই গুণ হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশকে এদের খাবার যোগাড় করতে কোনো সমস্যাতেই পড়তে হচ্ছে না। বিশ্বে এখন সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ছাগল উৎপাদনেও বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। তাছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতের জন্ম। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলা পড়ে পাকিস্তানে। এই অঞ্চলের মানুষের আন্দোলনের ফলেই মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সফল হয়। কিন্তু ২৪ বছরের শাসনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব অংশের প্রতি নানা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি সূচকেই পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ পূর্ব অংশের চেয়ে হয়ে উঠে সমৃদ্ধ। আর এর প্রতিক্রিয়ায় ফুঁসে উঠে বাঙালিরা। আর ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে অর্জন করে স্বাধীনতা।
এমনিতেই পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলের অবকাঠামো যুদ্ধের সময় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থবির হয়ে পড়ে অর্থনীতি, বিধ্বস্ত হয় সড়ক ও রেল যোগাযোগ, প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে অর্থনীতির চাকা। এমনকি যুদ্ধ চলাকালে সারাদেশে স্বাভাবিক ফসলও ফলাতে পারেনি কৃষক। দেশের রিজার্ভে ছিল না কোনো টাকা। এই অবস্থায় যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ আদৌ টিকে থাকতে পারবে না বলেই মত দিয়েছিলেন পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সে সময় বাংলাদেশকে তুলনা করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সঙ্গে। তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, এই ঝুড়িতে যা কিছু দেয়া হবে, তার সবই নিচ দিয়ে পড়ে যাবে।
যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের যাত্রাটাও সমৃন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সেনা শাসক আর রাজনীতিতে এর কুপ্রভাবের বলয় থেকে এখনও বের হওয়া যায়নি পুরোপুরি। তার সঙ্গে ছিল বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে বিরুদ্ধ পরিবেশেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আলোচিত এক দেশ। স্বাধীনতার পর শূন্য থেকে শুরু করা বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৩তম অর্থনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানোকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ প্যারাডক্স।
আর এই উন্নয়নে পাকিস্তানকে ছাড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপার দূরদর্শিতা। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশ এখন উন্নয়নের শিখরে। নিজেদের অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। আর এই সেতুতে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আরো হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দেশে যে আরো কত উন্নয়ন হচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না।