নিজস্ব প্রতিবেদক:
মেগাপ্রকল্প আর দেশজুড়ে অকাঠামো নির্মাণযজ্ঞে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে দেশের উন্নয়ন সাফল্য। অব্যাহত এ সাফল্যে সিমেন্টের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে ইস্পাতশিল্প। উদ্যোক্তারা বলছেন, বড় বড় প্রকল্প, দ্রুত নগরায়ণ এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি এ খাতে বড় চাহিদা তৈরি করেছে। সেই চাহিদা পূরণে বিনিয়োগও বেড়েছে। দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি চীনসহ আরো কয়েকটি দেশ এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান আরো বাড়বে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং বাড়তি শুল্ককরের বোঝা না চাপানো হলে এই শিল্পকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
ইবিএল সিকিউরিটিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে দেশে ইস্পাতের মাথাপিছু ব্যবহার ছিল ৪৫ কেজি। ২০২২ সাল নাগাদ এ চাহিদা বেড়ে হবে ৭৩ কেজি। দেশের শীর্ষ উৎপাদকদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে ৪০ লাখ মেট্রিক টন ইস্পাত উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য ছিল ৩৫৭ কোটি ডলার। ২০২২ সাল নাগাদ এ বাজার হবে দ্বিগুণ। আগামী দুই দশকে দেশের এ খাতে বার্ষিক দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হবে। বর্তমানে ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত দেশের সাতটি মেগাপ্রকল্পে বিপুল পরিমাণ ইস্পাতের প্রয়োজন হচ্ছে, কিন্তু করোনায় ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের দুষ্প্রাপ্যতা তৈরি হওয়ায় রডের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হচ্ছে স্ক্র্যাপ, স্পঞ্জ ও পিগ আয়রন। কাঁচামালের ৯০ শতাংশের বেশি আমদানি করতে হয়। ২০১৬ সালে এসব কাঁচামাল আমদানি হয় ২৫ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ মেট্রিক টন। যদিও ২০১৬ সালে দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এক কোটি মেট্রিক টন ইস্পাত আসে, যা দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করে।
উদ্যোক্তারা জানান, ভারী শিল্প ইস্পাত খাতে পণ্য উৎপাদনেই খরচ হয় আয়ের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। করোনায় ইস্পাতশিল্পের ক্ষতি ডিসেম্বর নাগাদ ১৫ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে।
ইস্পাত উৎপাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স সমিতির সভাপতি শেখ ফজলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনায় আমাদের অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। আগামী দু-তিন বছরেও এ ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারব কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’ ব্যবসায়ীদের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, এ শিল্প যেন সেটা দ্রুত পায় সেই দাবিও জানান তিনি।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের যেকোনো স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য আমরা বিশ্বমানের স্টিল (ইস্পাত) উৎপাদন করছি। স্টিল ইন্ডাস্ট্রির ১৬ লাখ টন উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে এখন হয়েছে বার্ষিক ৫৫ লাখ টন। চলতি বছরটি বাদ দিলে বছরে অন্তত ১৫ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সরকারের অবকাঠামো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে গতি অব্যাহত থাকলে এই শিল্পের সক্ষমতা আরো বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘ইস্পাতশিল্প হলো একটা দেশের উন্নয়নের হাতিয়ার। এই শিল্পকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের কথা চিন্তাই করা যায় না। আমরা আশাবাদী, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারলে আবার হয়তো ভালো প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যেতে পারব।’
সরকারকে নির্মাণ খাতে বেশি করে ব্যয় করার অনুরোধ জানিয়ে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেন গুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, এ খাত যদি প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে তবে সংশ্লিষ্ট সব খাত চাঙ্গা হবে। নির্মাণ খাত চাঙ্গা করে তুলতে হবে সরকারকে, এ জন্য চাহিদা তৈরি করতে হবে। যদি চাহিদা তৈরি হয়, তবে পণ্য বিক্রি বাড়বে। বিপুল অর্থপ্রবাহে চাঙ্গা হয়ে উঠবে নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব শিল্পই। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি টন স্টিল উৎপাদনে সরকারকে কর দিতে হয় কমপক্ষে এক হাজার ১৫০ টাকা, কিন্তু এ পরিমাণে কর দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ মুনাফা করা প্রয়োজন তা এ মুহূর্তে করা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০০ ইস্পাত কারখানা রয়েছে। মোট উৎপাদনক্ষমতা ৯০ লাখ মেট্রিক টন, যদিও দেশের বার্ষিক চাহিদা ৮০ লাখ টন।
ইবিএলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবুল খায়ের, বিএসআরএম ও কেএসআরএম বিলেট সক্ষমতার ৯০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার ৫০ শতাংশের বেশি পূরণ করে। এসব কম্পানির পাশাপাশি ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবসা বাড়াচ্ছে আনোয়ার গ্রুপ, কেএসআরএম, জিপিএইচ, আনওয়ার, রানি, এসএসআরএমসহ আরো অনেকে।
বাংলাদেশের ইস্পাতের বাজারে জোরালো অবস্থান তৈরি করতে যাচ্ছে চীনারাও। কুনমিং আয়রন ও স্টিল হোল্ডিং কম্পানি (কেআইএসসি) ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ থেকে সাত বছরে বাজারের বর্তমান কম্পানিগুলো আরো ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে এ খাতে।
গত বছর বিশ্বে অশোধিত ইস্পাত উৎপাদন হয় ১৮৬ কোটি ৯০ লাখ টন, যা ২০১৮ সালের চেয়ে ৩.৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে এশিয়ায় উৎপাদিত হয় ১৩৪ কোটি ১০ লাখ টন, যা আগের বছরের চেয়ে ৫.৭ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি নির্মাণ খাতের আরেকটি প্রয়োজনীয় পণ্য সিমেন্টশিল্পেও ভবিষ্যতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু করোনা মহামারিতে কারখানাগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বড় লোকসান গুনতে হয়েছে এ খাতে। ফলে ব্যবসা চালু রাখা এবং কর্মীদের বেতন পরিশোধ এখন তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এ শিল্পে প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
এ খাতের সংগঠন বিএসএমএ সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চায়। উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনায় সরবরাহব্যবস্থায় যে বিপর্যয় ঘটেছে তা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ৫০-৫৫ ডলার বাড়লেও দেশে ইস্পাতের দাম গত ছয়-সাত মাসে কমেছে ১৫ শতাংশ।
সংগঠনটির সভাপতি মানোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এ শিল্পটা শতভাগ আমদানিনির্ভর হওয়ায় অন্যান্য শিল্প থেকে বেশিই ক্ষতির সম্মুখীন। স্টিল উচ্চ বিনিয়োগ, উচ্চ চলতি মূলধন, উচ্চ ব্যয়বহুল একটি শিল্প। এ খাতে বিক্রি বেশি, কিন্তু মুনাফা কম। করোনায় এ শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। তাই এ মুহূর্তে ইস্পাতশিল্পে প্রণোদনার পাশাপাশি ভ্যাট, অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর ও রেগুলেটরি কর ছাড় চান তাঁরা।