এবার দেশেই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে এবং বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার চিন্তা থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ জুলাই আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে (বর্জ্য রাখার স্থান) দেশের প্রথম বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), স্থানীয় সরকার বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) যৌথভাবে এ নিয়ে প্রাথমিক কাজ করছে। আর প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে চায়না কোম্পানি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ডিএনসিসি ৩০ একর জায়গা দিয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক তিন হাজার টন বর্জ্যও সরবরাহ করবে। বিনিময়ে তারা জমি ভাড়া বাবদ বছরে ২ কোটি টাকা পাবে। তবে বর্জ্য সরবরাহ করতে হবে বিনামূল্যে। উৎপাদিত ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পিডিবি চুক্তি মূল্য অনুযায়ী কিনে নেবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২৩ সালের জুন থেকে ২৫ বছর মেয়াদের জন্য সরকার চায়না প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। প্রথম দুই বছর যাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণে। এরপর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা জানায়, বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে ঢাকার আবর্জনা কমবে। দৈনিক তৈরি হওয়া আবর্জনা ফেলে মূল্যবান জমি ভরাট করতে হচ্ছে। বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হলে নতুন করে কোনো জায়গা ভরাট করতে হবে না। পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমবে এবং পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে। আবর্জনাকে সম্পদে পরিণত করতে বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র ভালো ফলাফল বয়ে আনবে।
এ প্রসঙ্গে দেশের বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ডিএনসিসি অংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এসএম শফিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনঘনত্বপূর্ণ ঢাকার বর্জ্য অপসারণ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। জায়গা অধিগ্রহণ করে ঢাকার বর্জ্য ফেলে দুটি বিশাল ভাগাড় তৈরি হয়েছে। এখান থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণও ঘটছে।
তিনি বলেন, বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে নতুন করে আর বর্জ্যরে ভাগাড় তৈরি করতে হবে না। বর্জ্যরে ভাগাড় ব্যবস্থাপনার বার্ষিক খরচও কমে যাবে। এখন আমিনবাজার ল্যান্ডফিল ব্যবস্থাপনায় বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ হয়। বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পর থেকে যেটা আর হবে না। আগামী মাসের ৬ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করতে পারেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০১২ সালে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর আলোচনা শুরু করে। এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আলোচনা শুরু হয়। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি পৌরসভা এলাকায়ও বর্জ্য বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান ও বিদেশ সফর শুরু হয়। এক দশকের নানা আলোচনা ও উদ্যোগ বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে আগামী মাসে।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, সরকার প্রথমে ডিএনসিসির আওতাধীন একটি বর্জ্য বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১২ সালে ইতালিয়ান একটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে। ওই সময় আলোচনা হয়েছিল ইতালিয়ান প্রতিষ্ঠানটি প্রথম দেড় বছরে দুটি প্ল্যান্টে ১০ মেগাওয়াট, দুই বছরে ৩০ মেগাওয়াট এবং তিন বছরে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এ উদ্যোগ আলোচনার পর্যায়েই হিমঘরে চলে যায়। এ সরকারের মেয়াদের শুরুতে আবার বর্জ্য বিদ্যুৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের জোরালো পদক্ষেপে এবার আলোচনা, সেমিনার ও বিদেশ সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুব ভালো হওয়ার সুযোগ দেখছি না। এটা হতে পারে যে, বর্জ্যগুলো পুড়িয়ে ফেলা হবে। সেটাও ঢাকার জন্য অনেক সহযোগিতার ব্যাপার হবে। তবে পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিক যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার; সেগুলো নিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে সে বিষয়গুলো বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। কোনো বিচ্যুতি ঘটলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকায় টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ১৯৯০ সালে মাতুয়াইলে ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সেখানে গড়ে তোলা হয় ঢাকার প্রথম ল্যান্ডফিল; যেটা এখন পাহাড় আকৃতি ধারণ করেছে। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৬৪ লাখ ৮৭ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৩১ একর জমি অধিগ্রহণ করে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণ করা হয়। একই সঙ্গে আমিনবাজারে ৫০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে নতুন ল্যান্ডফিল গড়ে তোলা হয়। জায়গা ভরাট করে বর্জ্যরে ভাগাড় তৈরি বন্ধ করতে বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পথে হাঁটছে সরকার।