চিররঞ্জন সরকার
ফেসবুকে আপনি সব পাবেন। সব সমস্যার একেবারে ঘরে বসে সমাধান। প্রায় ‘বিনা চিকিৎসায়’ সব রোগের নিদান। সামান্য একটু গরম পানি কিংবা কালোজিরা অথবা আদা বা লেবু খাওয়া। প্রতিদিন জটিল-কঠিন-মারাত্মক সব ব্যাধি ও সমস্যার রাশি রাশি সহজ দাওয়াই ফেরি করে বেড়াচ্ছেন একদল মানুষ। তারা কেউই নিরক্ষর নন। কেননা ফেসবুক ব্যবহার করতে হলে আপনাকে সাক্ষর হতেই হবে। অনেকে আবার উচ্চশিক্ষিতও। তবু দাওয়াই বিতরণের ক্ষেত্রে কেউ কারো চেয়ে কম যান না।
সোশ্যাল মিডিয়া যতক্ষণ ‘সোশ্যাল’, ততক্ষণ নিরাপদ, কিন্তু সীমানা লঙ্ঘন করাই তার স্বভাব। এই মুহূর্তে যেমন করোনাক্রান্ত মানববিশ্বে কত দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াকে! চিকিৎসাবিজ্ঞান যে কথা এখনও জানে না, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ তা জেনে ফেলেছে! আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, দেশের গোপন সামরিক কর্মকাণ্ড— এ সবও তার নখদর্পণে। সবচেয়ে বেশি জানে করোনাভাইরাসের ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান।
অথচ তাচ্ছিল্য করে এড়িয়ে যাবারও উপায় নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে বিশ্ব এখন আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয়। অজানা উৎসের সংবাদ, অচেনা কণ্ঠের বার্তা, অদেখা স্থির বা চলমান ছবি তরঙ্গসম আছড়ে পড়ছে আমাদের মতো খবরলোভী মানুষের মধ্যে। সেই আমরা, যাদের খবরের চেয়ে অ-খবর বা গুজবের দিকেই অধিক মনোযোগ। সেই আমরা, যারা চমকে উঠতে ভালোবাসি এবং সেই চমকের ভাগ অতি দ্রুত ছড়িয়ে দিতে চাই চেনা-অচেনা সবাইকে। কখনও সামাজিক কল্যাণের শর্ত চাপিয়ে, কখনও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে। এমনি করে সোশ্যাল মিডিয়া আজ চমক দিয়ে ‘ঘুম ভাঙানিয়া’র বদলে ক্রমশ পরিণত হতে চাইছে ‘দুখ জাগানিয়া’য়।
এক সময় রেডিও-এর জায়গা কেড়ে নিয়েছিল টেলিভিশন; আজ রেডিও, টিভি, কাগজ সবাইকে টেক্কা দিয়ে লাগামহীন সোশ্যাল মিডিয়া বহুরূপে সম্মুখে আমাদের। সেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকা খবরের ভিড়, সেখানে সাংবাদিকতার বিধি নেই, তবু আমজনতাকে মোহিত করে রাখার মতো খবর আছে। ‘পাবলিক’ জানতে চায় না, এটা কোন কাগজের খবর বা সাংবাদিকটি কে? সমাজমাধ্যমের মধ্যে বেশ একটা ‘মাফিয়া-মাফিয়া’ গন্ধ আছে। অজানা গোপন উৎস থেকে উঠে আসছে খবর, বেশ একটা নিষিদ্ধ জগতের হাতছানি। তাই টানে বেশি। আর যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও দায় নেই, কারও নিয়ন্ত্রণ নেই তার উপরে, ভুয়া সংবাদ আর গুজবকে ‘খবর’ করে তোলার জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তাই তার লাগামহীন সংবাদ বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
এই করোনাকালে সবখানে লকডাইন, নিয়ন্ত্রণ, বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাইতো অবাধে চলছে ভুল-ধারণা-ছড়ানো, ভুয়া খবর উৎপাদন ও বিতরণ। শুভবোধ আর শিক্ষা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না, প্রযুক্তি এগিয়ে ভ্রান্তির মুখে লাগাম টেনে দিতে পারছে না, তখন ভাইরাসের মতো অবিশ্বাস্যরকম চাষবাস হচ্ছে মূর্খতার, বিশ্বাসের, অপযুক্তির।
এর অবশ্য কারণও আছে। ভয়ের থেকেই ভূত এবং ভগবানের জন্ম। আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই ভূত-প্রেত-সংস্কার-গুজবে আস্থাশীল বেশি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় তারা আরও ‘বিশ্বাসী’ হয়ে পড়েছেন। করোনাভাইরাসের বিপদ বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রতিরোধ করব, না অবাস্তবের ল্যাজ ধরে অবিজ্ঞানের চাষ করব— সেটাও কিন্তু এখন আমাদের সামনে এখন বড় সমস্যা।
করোনা থেকে রেহাই পেতে পৃথিবীর তাবৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানী-গবেষকরা দিন-রাত পরিশ্রম করে কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কার করতে না পারলে কি হবে, আমাদের দেশে এই রোগ থেকে পরিত্রাণের হাজারো টোটকার ছড়াছড়ি। শয়ে শয়ে টোটকা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ট্যুইটারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সামাজিক মাধ্যমগুলো এখন ‘সবজান্তাদের হাটে’ পরিণত হয়েছে।
অবশ্য অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, চাহিদা না থাকলে যোগান কমে যায়। আমাদের সমাজে আজগুবি জিনিসের চাহিদা সব সময়ই বেশি। অনেকে এ ধরনের আজগুবি টোটকায় বিশ্বাস করে নিরাময়ের পথ খোঁজেন। করোনার ভয়াবহতায় ভীত হয়েই কিনা জানি না, ফেসবুক-হোয়াটসআপ-ট্যুইটার-ইউটিউবে এখন করোনা থেকে পরিত্রাণের টোটকা দিয়ে বোঝাই। সেই টোটকার তালিকাটা শুধু দীর্ঘ নয়, বিচিত্রও। কেউ বলছেন বিশ মিনিট কড়া রোদে দাঁড়িয়ে ভিটামিন ডি শুষে নিলে সংক্রমণ-মুক্তি সম্ভব, কেউ আবার জানাচ্ছেন, এই ক্ষেত্রে রসুন অতি কার্যকর। প্রত্যেকদিন দুই-তিন কোয়া রসুন পানিতে গরম করে খেলে যে কোনও রোগমুক্তিই সম্ভব, কোভিড-১৯ তো সামান্য। অনেকে আবার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য করতে হু, ইউনিসেফ-এর বরাত দিয়ে বলছেন, প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর হালকা গরম পানি খেলে সংক্রমণের বিষ দূর হবে। কেউ বলছেন ঠান্ডা পানিতে উপকার অনিবার্য, কেউ বা গরম পানিতে আস্থাবান। তাদের মত হচ্ছে, উষ্ণ পানিতেই ভাইরাসের মৃত্যু অবধারিত। আদা, রসুন, দারুচিনি, লবঙ্গ, হরিতকি মিশিয়ে গরম পানিতে সেদ্ধ করে খাওয়ার পরামর্শও আছে। অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন লবণ-লেবু-গরম জল মিশিয়ে খেতে। আরও আছে কালো জিরা, মধু, থানকুনি পাতা, চা খাওয়ার পরামর্শ।
করোনার সম্ভাব্য সমাধান বিস্তর। একমাত্র চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরাই এই কাজে ব্যস্ত হন নাই, সমাজের নব-কবিরাজরূপী এক শ্রেণির মানুষও দায়িত্বসহকারে রোগমুক্তির উপায় সন্ধান এবং তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে তৎপর। সঙ্কটকালে এই স্বঘোষিত পণ্ডিতদের কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে। করোনা-সংক্রমণের প্রেক্ষিতে এই শ্রেণির মানুষের অতিসক্রিয়তা সমাজের পক্ষে ঘোর বিপজ্জনক। চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা বার বার সাবধান করছেন, এ ধরনের টোটকার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নাই। কিন্তু রোগভয়ে ভীত বাঙালি মন কেবল ফাঁদেই পড়তে চায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার স্থিতবুদ্ধির, গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলির মধ্যে তফাত করতে পারা। সকালে হালকা গরম পানি খারাপ না। কিন্তু উত্তাপে ভাইরাস মরে, এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতে গিয়ে ফুটন্ত পানি গলায় ঢাললে সমূহ বিপদ। বিপদসঙ্কেত বুঝবার ক্ষমতা লোপ পেলে সর্বনাশ। রসুন, আদা, কালোজিরা, লবঙ্গ, থানকুনি পাতা – সব কিছুরই ভেষজ গুণ আছে। কিন্তু কার শরীরে কোনটা কী পরিমাণ ধারণ করতে পারে সেটা কিন্তু ডাক্তারি পরামর্শের ব্যাপার। অতিরিক্ত মানেই কিন্তু বিষ, সেটা মধু হোক, আর অমৃত হোক!
আমাদের সমাজের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনও প্রথাগত চিকিৎসার বাইরের আজগুবি চিকিৎসায় আস্থা রাখেন বেশি। কারণ তা সহজলভ্য এবং সস্তা। সাধারণ অম্বলের সমস্যায় মানুষ ডাক্তারের কাছে না গিয়ে জামের বিচির গুঁড়া খান। কৃমি দূর করতে শিশুর মুখে কালমেঘ পাতার রস ঢালেন, লিভার ঠিক রাখতে কাঁচা হলুদ চিবান। সকলেই যে ভুল, এমন মনে করবার কোনও কারণ নাই। কিন্তু প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ যখন তাড়া করে, তখন এসব টোটকা সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। সেখানে প্রথাগত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার কাছে নত হতে হয়। নিজের স্বার্থে, দশের স্বার্থে।
কাজেই শুধু বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ভাইরাসটিকে প্রতিহত করাই নয়, লড়াইটা কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও। মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি, দূরত্ব বজায় রাখুন সোশ্যাল মিডিয়া নামক ‘সবজান্তাদের হাট’ বা ‘আহাম্মকের পাঠশালা’য় উৎপাদিত সব ধরনের আজব কিস্সা থেকেও। মনে রাখতে হবে, এ বড় সুখের সময় নয়!