নিউজ ডেস্ক:
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ শুধু রোল মডেল নয়। এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো, বজ্রপাত, ভূমিধসের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপরও দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির ঘটনা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল।
নদীবিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। তবে উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের হিমবাহ গলতে থাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং প্রাণঘাতী দুর্যোগ ঝুঁকি আরও বাড়ছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি জলবায়ু বিপদ হিসেবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ-আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। এ সময়ে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুর্যোগের কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়।
সারা দেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনে এলাকা ছাড়ছে অনেক মানুষ। রাজধানী ঢাকায় আগত ২১ ভাগ মানুষ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে এসেছে। নদীভাঙন নীরব ঘাতকের ভূমিকা পালন করছে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ স্বাভাবিক হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লেগে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বাড়ছে। উপকূলীয় অনেক এলাকার ৫০ ভাগের বেশি দরিদ্র মানুষ লবণাক্ততার কারণে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। সারা দেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন বাড়ছে।
সময়ে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে হচ্ছে। খরা বাড়ছে। এসব কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রকৃতির বৈরী আচরণে মানুষ আশ্রয়হীন হচ্ছেন। জলবায়ুর প্রভাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মিঠাপানির উৎস ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তু হবে। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ। এ তথ্য কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের।
এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড আর্লি অ্যাকশন ফর অল’ যার ভাবানুবাদ করা হয়েছে দুর্যোগে আগাম সতর্কবার্তা, সবার জন্য কার্যব্যবস্থা। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দুর্যোগ প্রশমন দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। এতে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’ উদযাপিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছর কোনো না কোনো দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ব্যাপকতা প্রমাণ করে দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকিহ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত। সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগ পূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কৌশল সফলতা পেয়েছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ আধুনিক আশ্রয়ণ প্রকল্প করেছে বাংলাদেশ। কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের বাঁকখালী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে এ প্রকল্প। প্রায় ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন ১৩৯টি পাঁচতলাবিশিষ্ট ভবনে চার হাজার ৪০৯টি পরিবার পুনর্বাসিত হচ্ছেন। এক হাজার ৮০০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০টি পাঁচতলাবিশিষ্ট ভবনে ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে নতুন ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে থাকছে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট। প্রকল্প এলাকায় ২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ৩৬ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, তীর রক্ষা বাঁধ, ছোট সেতু, ১৪টি খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, তিনটি পুকুর, নদীতে দু’টি জেটি এবং দু’টি বিদু্যতের সাবস্টেশন করা হয়েছে। প্রতিটি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার এক হাজার এক টাকার বিনিময়ে প্রায় ৪৫৬ বর্গফুটের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ফ্ল্যাট পাচ্ছেন। যেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথকর্ যাম্প, সোলার প্যানেল, বিশুদ্ধ পানির সুবিধা, বিদু্যৎ, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং গ্যাস সিলিন্ডার সংবলিত চুলার ব্যবস্থা রয়েছে।
সারা দেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমানে প্রায় ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। এছাড়া ৩২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবক, ২৪ লাখ আনসার ভিডিপি, ১৭ লাখ স্কাউটস, ৪ লাখ বিএনসিসি, গার্লস গাইডের প্রায় ৪ লাখ সদস্য- তারাও এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যেকোনো দুর্যোগের সময় তারাও জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানবতার কল্যাণে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিচক্ষণ নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্যোগঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ৯৪ হাজার ৩৩৮টি বাসগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও ৪৪ হাজার ৯০৯টি দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলে ৩২৭টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় ২৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে আরও এক হাজারটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পাশাপাশি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ-পরবর্তী অনুসন্ধান, উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সমন্বিতভাবে মোকাবিলার লক্ষ্যে ওয়ান স্টপ সেন্টার হিসেবে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনইওসি) প্রতিষ্ঠা করার কাজ চলছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম কার্যব্যবস্থা গ্রহণের কারণেই বাংলাদেশ আজ দুর্যোগ প্রশমনে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। আমরা সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই বার্তা দিয়ে দিচ্ছি, মানুষকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসি। ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রায় ৩০ লাখ উপকূলের মানুষকে আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে থাকি। সেখানে দুর্গতদের জন্য অর্থ, শুকনো খাবার, রান্না করা খাবার, পানীয়, স্যানিটেশন, নিরাপত্তাসহ সবকিছুর ব্যবস্থা থাকে। প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য আলাদার্ যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আলাদা কক্ষ রাখা হয়েছে, এমনকি তাদের জন্য আলাদা সুবিধাজনক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণে মৃতু্যঝুঁকিটা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর রেজাউল করিম যায়যায়দিনকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দুর্যোগ ঝুঁকি-হ্রাস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে সরকার ১০০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ প্রণয়ন করেছে। ২১০০ সাল নাগাদ স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসমূহের সমন্বয়ে যোগসূত্র সৃষ্টি করবে এ ডেল্টা পস্ন্যান। এভাবে দুর্যোগে ঝুঁকি হ্রাসে জীবন ও সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দুর্যোগ সহনীয়, টেকসই ও নিরাপদ দেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।