- সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইডের সহায়তা
- গত ছয় মাসে আইনী সহায়তা পেয়েছেন প্রায় ১৩শ’ মানুষ
- বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের তত্ত্বাবধানে চলছে মানবিক প্রতিষ্ঠানটি
বিকাশ দত্ত ॥ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি শেখ জাহিদ, কয়েদি নং-১৫২৭/এ, পিতা-শেখ ইলিয়াছ আহমেদ, গ্রাম -নারকেলী চাঁদপুর, থানা-রূপসা, জেলা-খুলনা। ১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি শেখ জাহিদের স্ত্রী রহিমা ও মেয়ে রেশমা খুন হন। এর বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কনডেম সেলে ছিলেন। অবশেষে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের সহায়তায় আইনী প্রক্রিয়া শেষে মুক্তি পান। শুধু শেখ জাহিদ নন জাহালাম ও প্রতিবন্ধী নারী নাজমাও তার অধিকার ফিরে পেয়েছেন। এভাবে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির নীরব তৎপরতায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। গত ৬ মাসে এক হাজার ২শ’ ৭৫ জনকে আইনী সহায়তা দিয়ছে প্রতিষ্ঠানটি। কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের সর্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে এই মানবিক প্রতিষ্ঠান। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইডের কো-অর্ডিনেটর রিপন পল স্কু জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা ভুক্তভোগীদের আইনী সহায়তা দিয়ে আসছি। করোনার সময়েও আমরা আইনগত সহায়তা প্রদান করে আসছি। শেখ জাহিদ, জাহালম ও নাজমা আক্তার আইনী সহায়তা নিয়েছেন এবং তারা তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছেন। তারা সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইডকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, বর্তমান করোনাকালীন পরিস্থিতির মধ্যেও তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি তাদের নিযুক্ত আইনজীবীর মাধ্যমে যা করছে তা সত্যিই বিরাট প্রাপ্তি।
২০ বছর পর কনডেম সেল থেকে মুক্তি জাহিদের ॥ ১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি শেখ জাহিদের স্ত্রী রহিমা ও মেয়ে রেশমা খুন হন। রহিমার বাবা সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার দায়ের করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা দণ্ডবিধির ৩০২ ধারানুযায়ী চার্জশীট দাখিল করেন শেখ জাহিদের বিরুদ্ধে। ১৮ জানুয়ারি, ১৯৯৮ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন শেখ জাহিদ। ২৫ জুন, ২০০০ তারিখে শেখ জাহিদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে বিচারিক আদালত (ঞৎরধষ ঈড়ঁৎঃ)। পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিভাগে ঔধরষ অঢ়ঢ়বধষ (জেল আপীল নং-২৫৩৩/২০০০) ও উবধঃয জবভবৎবহপব (ডেথ রেফারেন্স নং-২৩/২০০০) করা হয়। ৩১ জুলাই, ২০০৪ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে জেল আপীলটি খারিজ করে দেয়। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ জাহিদ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে জেল পিটিশন দাখিল করেন (জেল পিটিশন নং-১/২০০৫)। ২০২০ সালের ১ মার্চ খুলনা জেলা কারাগার জেল পিটিশন নং ১/২০০৫ এর অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হতে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসে একটি চিঠি প্রেরণ করে। তাৎক্ষণিকভাবে কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি এম.ইনায়েতুর রহিম আপীল বিভাগের রেজিস্ট্রারের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে কথা বলে চিঠির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। কয়েদি শেখ জাহিদের মামলার যাবতীয় তথ্য নিয়ে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস আপীল বিভাগের রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক পেপারবুক প্রস্তুত করার নির্দেশনা সম্পর্কেও অবগত করান। তাৎক্ষণিকভাবে আপীল বিভাগের রেজিস্ট্রার সংশ্লিষ্ট সকল শাখার কর্মকর্তাদের ডেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে খুলনা জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়।
অবশেষে গত ২৫ আগস্ট, শেখ জাহিদের জেল পিটিশন মামলাটি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়। ২০ বছর কনডেম সেল থেকে মুক্ত হয়েই লিগ্যাল এইড অফিসকে ধন্যবাদ জানান শেখ জাহিদ। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সরকারী আইনী সেবাপ্রাপ্তির মাধ্যমে দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্ত হয়েই যখন কেউ ধন্যবাদ দেয়, তখন মনে হয় কতটা সার্থক ও সফলভাবে চলছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার অধীন প্রতিটি লিগ্যাল এইড অফিস।
মুক্তি পেয়েছেন জাহালাম ॥ টাঙ্গাইলের নাগরপুরের জাহালম পেশায় একজন পাটকল শ্রমিক। কাজের সুবাদে স্ত্রী সন্তানসহ বাস করতেন নরসিংদীতে। ছোটবেলায় তার বাবা অন্যত্র বিয়ে করায় জাহালমের মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাদের তিনভাই তিন বোনকে বড় করেছেন। ঘটনাক্রমে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের ৩৩টি মামলার মধ্যে ২৬টি মামলার জের ধরে নরসিংদী থেকে তাকে ভুলবশত আবু সালেক হিসেবে আটক করে পাঠিয়ে দেয়া হয় টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানায়। পরে সেখান থেকে তোলা হয় টাঙ্গাইলের আদালতে তাকে প্রায় ১৮ কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগে জেলখানায় পাঠানোর নির্দেশ দেয়। সবশেষে তার ঠাঁই হয় কাশিমপুর-২ কারাগারে। পরবর্তীতে মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে দেখতে পায় যে ভুল আসামি হিসেবে প্রায় তিন বছর ধরে কারাগারে আছে জাহালম।
২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত। পরে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ জাহালমকে ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তির আদেশ দেয়। তবে আরও ৭ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল না হওয়ায় সে বিষয়ে আদেশ দেয়নি আদালত। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান তিনি। শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করে। জাহালমকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য ব্র্যাক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এক মাসের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংককে এই অর্থ পরিশোধ করতে বলেন। যেহেতু জাহালমকে ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। সে কারণে ব্র্যাক ব্যাংককে এই জরিমানা দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে এই ভুল তদন্তের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। অন্যদিকে আপীল বিভাগে আইন সহায়তার প্রত্যাশায় সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসে আবেদন করে জাহালম। ইতোমধ্যে আপীল বিভাগে বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে রেখেছে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। অসহায় মানুষকে আইনগত সহায়তা প্রদান করতে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস বদ্ধপরিকর।
অধিকার ফিরে পেয়েছে প্রতিবন্ধী নাজমা ॥ রাজবাড়ী জেলার মোছাঃ নাজমা আক্তার একজন গৃহিণী। বিগত ২১/১২/২০০৮ তারিখে উভয় পক্ষের সম্মতিতে পারিবারিকভাবে মোঃ জাকির হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। নাজমা আক্তারের বকেয়া দেনমোহর কোন অর্থ, সম্পদ বা স্বর্ণালঙ্কার দ্বারা পরিশোধিত নয়। বিবাহিত জীবনে জাকিয়া সুলতানা (৭) ও রাহাত হোসেন (৫) নামে তাদের দুটি সন্তান আছে। নাজমা আক্তারের স্বামী জাকির হোসেন তার কাছে যৌতুক দাবি করলে নাজমা আক্তার তা দিতে অস্বীকার করলে জাকির হোসেন ইচ্ছাকৃতভাবে নাজমা ও তার সন্তানদের ছেড়ে অন্যত্র বসবাস শুরু করেন এবং খোরপোষ দেয়া হতে বিরত থাকে।
উল্লেখ্য, জাকির হোসেন পূর্ব বিবাহিত যা গোপন করে ভুল ঠিকানা দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নাজমা আক্তারকে বিয়ে করে। বর্তমানে সে তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন যাপন পরিচালনা করছে। নাজমা আক্তার একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী বিধায় বিয়ের সময় নাজমাকে তার পিত্রালয় থেকে ৫/৭ লাখ টাকার আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবহারসামগ্রী উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করে যা পরবর্তীতে তার স্বামী জাকির হোসেন বিক্রয় করে ফেলেন। ২০১৫ সালের নবেম্বর মাসে নাজমা তার স্বামীর বাড়িতে গিয়ে তার অনাদায়ী দেনমোহর এবং তার ও তার সন্তানদের খোরপোষ দাবি করলে জাকির হোসেন দিতে অস্বীকার করেন। ফলে ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা নং- ১৪২/২০১৫। পারিবারিক আদালত ২০১৬ সালের ৭ নবেম্বর নাজমাকে তার বকেয়া দেনমোহরের টাকা ও তাদের ভরণপোষণের টাকা পরিশোধের জন্য জাকির হোসেনকে নির্দেশ দেয়। এরপর জাকির হোসেন রাজবাড়ী যুগ্ম জেলা জজ আদালতে পারিবারিক আপীল (১৪/২০১৭) করেন। কিন্তু আপীল আদালত ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাকির হোসেনের আপীলটি নামঞ্জুর করে এবং পারিবারিক আদালতের ডিক্রি বহাল রাখে। পরবর্তীতে জাকির হোসেন হাইকোর্ট বিভাগে সিভিল রিভিশন ২৯৩৬/২০১৮ দায়ের করেন। উক্ত রিভিশনের বিপক্ষে নাজমা আক্তার আইন সহায়তার জন্য সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসে আসেন। সুপ্রীম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল ডিসচার্জ করে পূর্বের রায় ও ডিক্রি বহাল রাখে।