রহমান রা’আদ
দুই নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার মেলাঘর থেকে ট্রেনিং নিয়ে মাত্রই ঢাকায় ফিরেছে আরবান গেরিলার প্রথম দলটি। ১৭ জন গেরিলার দলটিতে রয়েছেন: আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীন, মাহবুব আহমাদ (শহীদ), শ্যামল, ভাষণ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাট্যকার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে), ফতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাইদ খান, আনোয়ার রহমান (আনু), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ, গোলাম দস্তগীর গাজী, তারেক এম আর চৌধুরী, নজিবুল হক, রেজা (ধানমন্ডি), আব্দুস সামাদ (আড়াইহাজার), জব্বার (রুপগঞ্জ), ইফতেখার এবং হাবিবুল আলম। এদের উপর খালেদ মোশাররফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অপারেশনের দায়িত্ব দিয়েছেন। এই অপারেশনের উপরেই নির্ভর করছে ঢাকায় গেরিলা ওয়্যারফেয়ারের ভবিষ্যৎ। ঢাকার এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল- হিট অ্যান্ড রান!
যদিও তাদের মূল টার্গেট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ (সাবেক হোটেল শেরাটন এবং বর্তমানে রূপসী বাংলা) অবস্থান নেওয়া বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআরের ডেলিগেট টিমকে ভয় দেখানো, তবুও তাদের বলা হয়েছে ঢাকার আশপাশে গ্রেনেড ফাটাতে। কোনোভাবেই যেন পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না জড়ায় গেরিলারা, সে ব্যাপারে কড়া অর্ডার দিয়েছিলেন মেজর এটিএম হায়দার এবং শহীদুল্লাহ খান বাদল। কারণ, একে তো গেরিলাদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই, দ্বিতীয়ত শুরুতেই সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানীদের সাথে লড়াইয়ে নামার কোন পরিকল্পনা ছিল না হাই কমান্ডের।
গেরিলাদের দেওয়া হয়েছিল মাত্র ১২টি গাঢ় কালচে বাদামি রং-এর ‘পাইন আপেল টাইপ’ হ্যান্ড গ্রেনেড আর একটি করে বেয়নেট। ১৬০ রূপি (তৎকালীন পাকিস্তানী মুদ্রা) নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা সবাই ঢাকায় পৌঁছেছিলেন ৩ জুন। বিজ্ঞাপন
অপারেশনের জন্য প্রাথমিকভাবে গেরিলা জিয়া, মায়া, স্বপন, ভাষণ, হাবিবুল আলম এবং ভাষণের মামা মুনির আলম মির্জা (বাদল) নির্বাচিত হলেন। স্বপন আগেই জানিয়েছিল যে তার কাছে একটা পিস্তল আছে কাভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য। অপারেশনের জন্য একটা গাড়ির প্রয়োজন ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সবাই মিলে গুলশান ১ নম্বর গোলচত্ত্বর থেকে একটা গাড়ি হাইজ্যাক করা হবে। সিদ্ধান্ত মত ৭ই জুন থেকেই গাড়ি ছিনতাইয়ের চেষ্টা শুরু করে গেরিলারা। কিন্তু প্রথম দিন ভাষণের জন্য কোন গাড়িই ছিনতাই করা যায়নি। যতগুলো গাড়ি যাচ্ছিল, সেগুলোর মালিকেরা হয় ভাষণকে চেনেন, অথবা ভাষণ তাদের চেনে। হয় তাদের আত্মীয় বা বাবার সহকর্মী। দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ৮ই জুনেও একই অবস্থা, যে গাড়িই পছন্দ হয়, সেই গাড়ি দেখেই ভাষণ বলে, এটা আমার চাচা বসে আছেন, অথবা ওটায় আমার খালুর ভাই বসে আছেন, ছিনতাই করা যাবে না। বিরক্ত হয়ে সেদিনও গাড়ি ছিনতাই না করে সবাই ফিরে আসে তাদের আস্তানায়।
আবছা আলোয় ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে টুকরো টুকরো কথা। ভেতরে বসে আছে তিনজন, আলম, মায়া এবং জিয়াউদ্দিন। সবাই খুব বিরক্ত। তাদের টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝেঃ
জিয়া: ঢাকা শহরে এতোগুলা সম্বন্ধী রাইখা ওরে যুদ্ধে আসতে বলছে কে? মনে চাইতেছিল শালার মাথার উপ্রে…
মায়া: আরে থাম তো, আচ্ছা কালকে আর ওরে নিমু না, ঠিক আছে?
একটু পর দরজায় সাংকেতিক শব্দে নক হলো। জিয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই স্বপন দ্রুত পায়ে ঢুকে পড়লো। আলম একটা সিগার ধরানোর চেষ্টা করছে। প্রথমবার ধরলো না, বিরক্তিতে একটা গালি বের হয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সিগার ধরলো। তারপর মায়া ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে মোম ধরালো। তারপর একটা তোয়ালে ছুড়ে দিল স্বপনের দিকে। স্বপন মাথামুখ মুছে প্রথম কথাটা জিজ্ঞেস করলো,
– ভাষণ কই?
– (জিয়া তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো) অয় যুদ্ধ করবো নাকি ওর আত্মীয়স্বজন সামলাইবো? আজকের দিনটাই মাটি হইল ওর লাইগা। যেই গাড়িরেই টার্গেট করি, সেইটাতেই তার চাচা-খালু-কাজিন-বন্ধুসহ সকল জ্ঞাতিগুষ্ঠি পাওয়া যায়। লাগে জানি ঢাকা শহরের সবাই তার দুলাভাই লাগে। আপনা আদমি। তাদের গাড়ি সে হাইজ্যাক করতে পারবে না। তা সবার লাইগা তার এতোই যখন দরদ, হালায় যুদ্ধ করতে আইছে ক্যা?
মায়া: আগামীকাল আর ওরে নেওন যাইবো না, বুঝলা? প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান নেতৃত্বে জাতিসংঘ আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ডেলিগেটরা আগামীকাল সন্ধ্যায় ঢুকবো ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এইটাই বেস্ট চান্স। বিকালের মধ্যে যেমনেই হোক একটা গাড়ি হাইজ্যাক করতে হবে। ভাষণরে নিলে দেখা যাবে কালকেও তার ফিউচার শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন বাইর হবে গাড়ি থেকে। কালকেও হাইজ্যাক করা হবে না। কোন দরকার নাই। কালকে খালি আমরা চাইরজন আর গাড়ি চালানির লাইগা বাদল ভাই যাবো। ঠিক আছে?
স্বপন: কি আর করা, এইটা ছাড়া তো আর কোন উপায় নাই। ও থাকুক, পরে অন্য কোন অপারেশনে যাবে।
মায়া: হ, সেইটাই। এইটা প্রথম হিট, খুব সিরিয়াসলি নিতে হইব। পাইক্কারা দুনিয়া জুড়ে বইলা বেড়াচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান পুরা কন্ট্রোলে, পরিস্থিতি পুরা স্বাভাবিক। ২০০ কোটি টাকা ঋণ পাইবো ইয়াহিয়া সরকার যদি এই প্রোপ্যাগান্ডা পাকিস্তান গর্ভমেন্ট ডেলিগেটগুলারে খাওইয়াইতে পারে। বুঝতেই পারতেছ অর্থনৈতিক সাহায্যের কথা বইলা এই টাকাটা নিয়া শালারা আরো অস্ত্র কিনবো আমাগোরে মারার লাইগা। এইটা হইতে দেওয়া যাবে না। যেমনেই হোক এদের ভয় দেখাইতে হবে। ডেলিগেটদের গাড়ি উড়ায়া দিবো আগামীকাল আমরা।
স্বপন: কিন্তু মেলাঘর থেকে না খালেদ মোশাররফ বলছিলেন ঢাকার আশেপাশে তিন চার কিলোমিটারের মধ্যে গ্রেনেডগুলা ফাটাইতে?
মায়া: আরে ধুর, যদি ভয় দেখাইতেই হয়, অতদূরে যাবো কেন? সরাসরি হোটেলে অ্যাটাক করবো আর ডেলিগেটদের গাড়ি উড়ায়া দিমু, যেন কয়েকটা মরে আর বাকিগুলা জান নিয়া পালায়া যায়।
(জিয়া মাঝপথে থামালো মায়াকে) ডেলিগেটগুলারে পালাইতে দিমু ক্যান? সবগুলারে নগদে ফালায়া দিমু, কাহিনি খতম। গ্রেনেডে যেগুলো মরবে না, দরকার হইলে স্বপন পিস্তল দিয়া গুলি কইরা মারবে সেইগুলারে।
মায়া: আরে না না, সবগুলারে মাইরা ফেলার সময় কই? পাইক্কারা ঘিরা ফালাইবো না? রিস্ক আছে বহুত। মনে নাই মেলাঘর থেকে কি অর্ডার দেওয়া হইছে? খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের দায়িত্ব আলমরে দেওয়ার আগে বারবার করে বলছেন, সম্মুখ যুদ্ধে জড়াবা না, অপারেশনটা জাস্ট হিট অ্যান্ড রান টাইপ হবে। সম্মুখ যুদ্ধে জড়ানোর মত ট্রেইন্ড না আমরা, আর কোনভাবে আমাদের মধ্যে কেউ ধরা পড়ে গেলে বিশাল ক্ষতি, ঢাকার গেরিলা ওয়ারফেয়ার তিন মাসের জন্য পিছায়া যাবে। সুতরাং আমরা স্রেফ গ্রেনেডগুলা দিয়া গাড়ি উড়ায়াই রিট্রিট করবো, এতে কতগুলা মরবে আর বাকিরা এমন ভয় পাবে যে জিন্দেগীভর স্মরণ রাখবে।
স্বপন: এইটা অবশ্য ভালো বলছো। ঠিক আছে, এইটাই সই। গ্রেনেড নিমু কয়টা করে আমরা?
মায়া: আলম আমারে একটু আগে পুরা প্ল্যানটা বুঝায়া বলছে। শুনো, আমি, আলম আর জিয়া গ্রেনেড থ্রো করবো। প্রত্যেকের কাছে তিনটা করে ‘পাইন অ্যাপেল’ থাকবে। তুমি পিস্তল দিয়া কাভার দিবা বাই এনি চান্স কোন গড়বড় হইলে। বিকালে বাদল ভাই তার মাজদা গাড়িটা দিয়ে যেকোন একটা গাড়ি আটকাবে সামনে দিয়ে আর পেছন থেকে আলম তার ট্রায়াম্ফ হেরাল্ড দিয়ে ব্যারিকেড দেবে। তারপর গাড়িটা নিয়ে আমরা রাত আটটার আগেই চলে যাবো ইন্টারকন্টিনেন্টালে, প্রেসিডেন্ট ভবনের ডানে মোড় নিয়ে তিন রাস্তার মাঝখানের বড় গাছ পার হয়ে সরাসরি হোটেল সাকুরার সামনে দিয়ে হোটেলের গেইটের সামনে পজিশন নিমু। গাড়ি থামার পর আলম সংকেত দিলে একলগে সবার গ্রেনেড চার্জ করবো গাড়িটার উপর। এনি কোশ্চেন?
স্বপন: হোটেলের সামনে কি সবগুলা গ্রেনেড চার্জ করা হবে?
মায়া: না। আমাদের কাছে থাকবে মোট নয়টা গ্রেনেড, প্রত্যেকের কাছে তিনটা করে। হোটেলের সামনে চার-পাঁচটা ফাটানোর পর যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি নিয়ে বেইলি রোড হয়ে মতিঝিলে মর্নিং নিউজ অফিসের কাছে চলে আসবো। অফিসের বাউন্ডারির ওপর দিয়ে দুইটা গ্রেনেড থ্রো করেই সটকে পড়বো। রমনা থানার পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে মগবাজার কাজী অফিসের উল্টা দিকে গোলাম আজমের বাড়ির দুই তলায় বাকি দুইটা গ্রেনেড মারা হবে। মোট নয়টা পাইন অ্যাপেল গ্রেনেডে কালকে ঢাকা কাঁপায়া দিমু। ঠিক আছে?
(পেছন থেকে আলমের ভারী গলা শোনা গেলো)
আলম: টাইমিং ইজ এভ্রিথিং। এক চুল এদিক ওদিক হলেই কিন্তু আমরা বিপদে পড়ে যাবো। হেজিটেট করা যাবে না, কনফিউজড হওয়া যাবে না। আহত হলেও সমস্যা, ধরা তো পড়া যাবেই না। সুতরাং খুব বেশি রিস্ক নেবো না আমরা। ঠিক আছে?
মায়া: অপারেশন শেষ কইরাই আমরা অতি দ্রুত যার যার বাসায় ফিরা যাবো। পরেরদিন সকালেই আমি, মায়া আর জিয়া মেলাঘর চলে যাবো। স্বপন, তুমি চুল্লু ভাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবা। এদিকে খেয়াল রাখবা। টু আইসি শহীদরে দেওয়ার লাইগা আলম একটা চিঠি রাইখা যাবে তার বোনের কাছে। সে বাকিদের খোজখবর রাখবে। ইজ এভ্রিথিং ক্লিয়ার?
পরদিন ৯ই জুন, ১৯৭১। ঠিক আগের দিনের প্ল্যানমত সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে একটা নীল ডাটসান ১০০০ গাড়ি ছিনতাই করলো ওরা। ড্রাইভিং শুরু করলেন ক্যামেরাম্যান বাদল, পাশেই পিস্তল হাতে বসে ছিলেন স্বপন। পিছনের আসনের বাম দিকে জানালার পাশে মায়া, ডান দিকের জানালার পাশে হাবিবুল আলম আর দুজনের মাঝখানে জিয়া। এই অপারেশনের জন্য পেছনে বসা তিনজন তিনটা করে সবমিলিয়ে নয়টা গ্রেনেড নিয়েছিল। গাড়িটি প্রেসিডেন্ট ভবন (বর্তমানে সুগন্ধা) ছাড়িয়ে ডানে মোড় নিয়ে তিন রাস্তার মাঝখানের বড় রাস্তা পেরিয়ে বাম দিকে মোড় নেয়। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সীমানা দেয়াল। ধীর গতিতে গাড়িটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাদল, গেরিলারা দেখতে পেলো হোটেলের দেয়ালের উপর বসা নানা ধরণের টুপি পড়ে অনেক মানুষ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে হোটেলের দরজার দিকে। যেন নামীদামী কোন মানুষকে দেখতে বা স্বাগত জানাবার অপেক্ষায় আছে তারা। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এগুলো হচ্ছে চাটুকার শ্রেণীর বাঙ্গালি, বিহারি কিংবা রাজাকার!
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঠিক মাঝ বরাবর পৌঁছে হঠাৎ গেরিলারা সাইরেনের শব্দ পেল এবং দেখলো সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের একটি এস্কর্ট দল ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে। আর পেছন পেছন আসছে পুলিশের আরও দু-তিনটি গাড়ি। শেষ গাড়িটি ছিল ৬০ দশকের মাঝামাঝি মডেলের একটি শাদা শেভ্রোলেট, যার মাঝ বরাবর চকলেট রঙ-এর ডোরা দাগ। প্রচণ্ড নিরাপত্তা দেখেই বোঝা গেল এ গাড়িতেই আছে ডেলিগেটেরা, যাদের জন্য মতিনগর থেকে পাঠানো হয়েছে গেরিলাদের। পাহারার মাঝ দিয়ে গাড়িগুলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
সাথে সাথে বাদল মিন্টো রোডের দিক থেকে একটা শার্প ইউটার্ন নিয়ে ফুটপাত সংলগ্ন হোটেলের ছোট গেটে এসে থামালো গাড়িটা। তখনকার নিয়ম ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দহলিজ বা টেরেস এবং তার রিভলভিং এনট্রান্স বা ঘুর্ণায়মান প্রবেশ পথ বরাবর ছোট গেটটি দিয়ে পথচারীরা হোটেলে ঢুকতে পারতেন। গাড়িবহর দেখা মাত্রই হোটেলের দেওয়ালের উপর বসে থাকা বা হাঁটতে থাকা বেঈমান বাঙ্গালীরাহাত তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে উঠলো। তারা খেয়ালি করেনি যে একটা সাদা ডাটসান থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চারজন মুক্তিযোদ্ধা হেঁটে তাদের পেছনের ছোট গেটটির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য খেয়াল করলেও তারা কিছু বুঝতো কিনা সন্দেহ, কারণ এই আরবান গেরিলাদের বেশ দামী পোশাক পড়া সভ্য ভব্য চলাফেরা দেখে বোঝার কোন উপায় ছিল না যে কি দুর্দমনীয় সাহসী এরা!
যাই হোক, ততক্ষণে হোটেলের টেরেস বরাবর এবং রিভলভিং এনট্রান্সের পাশেই সাবধানে নিঃশব্দে ৩ থেকে ৪ ফুট দূরে দূরে পজিশন নিয়েছে আলম, মায়া ও জিয়া। আর একটু দূরে স্বপন শার্টের নিচে পিস্তলের বাঁটে হাত রেখে অপেক্ষা করছিল। গাড়িটা থামতেই আলম গ্রেনেড থেকে পিন খুলে দেখে যে জিয়া ততক্ষণে তার গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছে, প্রচন্ড বিস্ফোরণের প্রকট আওয়াজের পর ওরা দেখলো গাড়িটা উল্টে গিয়ে টেরেসের কোণায় গিয়ে পড়েছে। গাড়ি থেকে দুজন বের হবার চেষ্টা করছে। ঠিক সে মুহুর্তে আলম তার গ্রেনেড ছোঁড়ে, সেটা গিয়ে পড়লো রিভলভিং দরজার কাছে, সাথে সাথে মায়ার ছোঁড়া তৃতীয় গ্রেনেডটাও পড়লো একই জায়গায়!
ততক্ষণে চারদিকে প্রচণ্ড শোরগোল আর হতবিহবল পাকিস্তানী সেনাদের মাঝেই নিজের দ্বিতীয় এবং সবমিলিয়ে চতুর্থ গ্রেনেড ছোঁড়ে জিয়া। উল্টে যাওয়া গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে গ্রেনেডটা ভেতরে পড়েই বিস্ফোরিত হয় এবং আলম দেখতে পায় শেভ্রোলেট গাড়িটির পেছন দিকটা হঠাৎ তিন-চার ফুট উপরে উঠে গিয়ে আবার নিচে পড়লো। সম্ভবত মায়া তারপর আরও গ্রেনেড ছুঁড়েছিল, ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তুপে অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক।
সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! প্রচন্ড শোরগোলের ভেতর সবাই নিজের চোখে প্রথমবারের মত ভয়ংকর পাকিস্তানীদের উপর অসমসাহসে আক্রমণ দেখলো। সাথে সাথেই গেরিলা চারজন গাড়িতে উঠতে না উঠতেই এক্সিলেটরে পা দাবিয়ে গাড়ি টান দিল বাদল। ঘুরিয়ে মিন্টো রোড ধরে ফেরার পথে গেরিলারা দেখলো যে হোটেলের সীমানা দেয়ালে বসে থাকা সব বেইমানগুলো প্রাণভয়ে পালিয়েছে, চারপাশে স্যান্ডেল, লুঙ্গি আর মাথার টুপি পড়ে আছে অনেক। এরপর গাড়িটা সুগন্ধার পাশ দিয়ে বেইলী রোডে ঘুরিয়ে ডানদিকে সামরিক জান্তা সরকারের অন্যতম দৈণিক পত্রিকা মর্নিং নিউজ অফিসের পাশে নিয়ে আসে বাদল। গাড়িটা একটু স্লো করে পত্রিকা অফিসের সীমানা দেওয়ালের উপর দুটো গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে আলম, প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে আশপাশ। এরপর দ্রুত সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজারের কাজী অফিসের পাশে জামায়াতের আমীর ও গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আজমের বাসভবনের পাশে আসে ওরা, বাড়ির উপর দুটো পর পর দুটো গ্রেনেড ছোঁড়ে মায়া। গ্রেনেড দুটো গিয়ে বাড়ির ভেতরে আঘাত হানলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন বাসায় গোলাম আজম ছিল না। সেদিনি গোলাম আজম শেষ হয়ে গেলে হয়তো আজ আমাদের ইতিহাসটা অন্যরকম হতেও পারতো।
দ্রুতগতিতে সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্ল্যানমত যে যার বাসায় চলে যায়। পরবর্তীতে তারা মেলাঘরে ফেরার পর গেরিলারা এই অপারেশনের সাফল্য সম্পর্কে জানতে পারে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ আগেই বিবিসি এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও’র খবরে অপারেশনের কথা জানতে পেরেছিলেন। এই অপারেশন করার কথা ছিলো ইন্টার কন্টিনেন্টালের আশেপাশের এলাকায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা হোটেল ইন্টাকন্টিনেন্টালে আক্রমণ করে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেওয়ায় বিশ্ববাসীই শুধু বিস্মিত হয়নি। বিস্মিত হয়েছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারও। বিশেষ করে খালেদ তো বিবিসিতে এই খবর শুনে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে।’
সেই থেকেই এই মুক্তিপাগল আরবান গেরিলা দলের নাম ক্র্যাক প্লাটুন।
তথ্যসুত্র:
১। ব্রেইভ অফ হার্ট – হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
২। বারে বারে ফিরে যাই—ডাঃ মেজর আখতার বীর প্রতীক।
৩। আলতাফ- অমিত গোস্বামী