সাব্বির আহমেদ
করোনায় দুই মাস পার করল বাংলাদেশ। এ ভাইরাসটির থাবায় ধুঁকছেন সবাই। দিনকে দিন বাড়ছে প্রাণহানি। রোজ আক্রান্ত হচ্ছে রেকর্ড সংখ্যক। কোভিড-১৯-এর কারণে সবচেয়ে বিপাকে আছেন দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্য আয়ের কোটি কোটি মানুষ। ত্রাণের জন্য ছুটছেন এদ্বার থেকে ওদ্বার। জীবিকার তাড়নায় জনপ্রতিনিধিদের দরজার কড়া নাড়ছে কর্মহীন জনগণ। এই জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই মাঠে থাকলেও করোনায় কোথাও নেই বেশ পরিচিত মুখগুলো। যাদেরকে জনগণ সদা টেলিভিশন কিংবা সভা-সেমিনারের বক্তৃতায় দেখে থাকেন। ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব কিংবা বঙ্গবীর কাদের চৌধুরী। এই নামগুলো ভোটের আগে জনগণের কাছে প্রায়ই ভেসে আসে। কয়েকদিন পরই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির নানা দ্ব›েদ্ব খবরের শিরোনাম হয়ে থাকেন। হঠাৎই সংবাদ সম্মেলনে এসে সরকার ও বিএনপির বিষোদগার করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই দুর্দিনে তাদের কী পাশে পাচ্ছেন জনগণ? আওয়ামী লীগ, বিএনপি নানাভাবে মাঠে থাকার চেষ্টা করলেও আলোচিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেই কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। ঐক্যের ডাক দিয়ে নিজেরাই গুটিয়ে আছেন।
ভোটের আগে ব্যাপক আলোচিত এই ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জানান, ইচ্ছে থাকলেও তারা করোনার দুর্যোগে সমন্বিতভাবে কিছু করতে পারছেন না। তবে সবার সাধ্যমতো চেষ্টা করা উচিত বলছেন তারা। সে জন্য ঐক্যফ্রন্ট করোনা মোকাবেলায় ৫ দফা দাবিতে ঐক্যের ডাক দিয়েছিল গত মাসের শুরুতে।
বয়স ও রোগের বাড়ে নুব্জ অনেক আগে থেকে ঘরে আছেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, জনগণকে ঘরে রাখতে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে সরকারিভাবে। চাইলেও অনেক কিছু সম্ভব হচ্ছে। তবে যে যার মতো জনগণের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
একদিকে মাঠে দেখা যায়নি ড. কামাল হোসেনের প্রতিষ্ঠিত দল গণফোরামকে। জনগণের পাশে দলটি কেন দাঁড়াচ্ছে না, জানতে দলের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ছোট আকারে বিভিন্ন জেলায় ত্রাণ দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি জনগণের পাশে থাকতে।
ঐক্যফ্রন্টের বড় দল বিএনপি তাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম দেশ জুড়ে চালাচ্ছে। তবে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সমন্বয় নেই। আর পরিস্থিতির কারণেই এই সমন্বয় করা যাচ্ছে বলে দাবি করেন ফ্রন্টের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। তিনি জানান, ঐক্যফ্রন্ট জড়ো হয়ে কিছু করছে না। কারণ পরিস্থিতি অনুক‚লে নেই। তবে তার দল জেএসডি রাজধানী ও তার বাইরে অনেক জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করছে।
তবে ফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহŸায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কিছুটা নাখোশ ঐক্যফ্রন্টের স্থবিরতায়। তিনি বলেন, আসলে জোটের পক্ষ থেকে করোনায় ঐক্যবদ্ধ কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। তবে নাগরিক ঐক্যে ও তিনি ব্যক্তিগতভাবে কর্মহীন অসহায়দের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেকটা ব্যতিক্রম অন্যদের থেকে। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে তিনি ভাইরাসটির নমুনা পরীক্ষার কিট উদ্ভাবন করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি দুস্থ গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন।
ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মাঠে না দেখে জনগণও বেশ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, সুদিনে শুধু টকশোতে ঝড় তোলেন ফ্রন্টের নেতারা। দুর্দিনে তারা লুকিয়ে আছেন। এই নেতারা শুধু সভা-সেমিনারে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে থাকেন। কিন্তু নিজেরাই জনগণের পাশে থাকেন না।
জানা যায়, ঐক্যফ্রন্টের দুটি কমিটি আছে। একটি স্টিয়ারিং আরেকটি সমন্বয়ক। এতে প্রায় দুই ডজন সদস্য রয়েছে। জাতীয় দুর্বিপাকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দেখা পাচ্ছেন না জনগণ।
এদিকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকেও জনগণের চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে না মাঠে। আর্থিক দৈন্যতায় পার্টির মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বিত উদ্যোগ নেই বলে জানানো হয়েছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে পার্টির নেতারা কিছু করলেও সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদকে কাছে পাচ্ছেন না ময়মনসিংহের মানুষ। নিজ নির্বাচনি এলাকায় না থেকে ঢাকায় আছেন অভিযোগ উঠেছে। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে করোনা মোকাবেলায় নানা বিবৃতি দিচ্ছেন পার্টির অন্যতম শীর্ষনেতা রওশন। করোনার শুরুতে রাজধানীতে কিছু কর্মসূচিতে দেখা গেলেও এখন অনেকটা চুপসে আছেন পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ঢাকার উত্তরার বাসা থেকে পাঠাচ্ছেন বিবৃতি।
এদিকে বিকল্পধারার গণমাধ্যম কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাদের দলের দুই সংসদ সদস্য নিজ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন এবং করবেন।
দেশের আরেক প্রবীণ নেতা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। করোনা শুরুর পর সংবাদ মাধ্যমে অর্ধডজন বিবৃতি পাঠানো ছাড়া কিছুই করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি নতুন প্লাটফর্ম জাতীয় মুক্তিমঞ্চের আহŸায়ক অলি আহমদকে জনগণের পাশে ক্ষুদ্র পরিসরেও পাননি হতদরিদ্র মানুষ। মুক্তিমঞ্চ থেকে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
আরেক আলোচিত নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষোভ ঝেড়ে ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যান কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের এই সভাপতি। করোনাভাইরাস রোধে মাঠে নেই তার দল। নিজেকেও রাখছেন গুটিয়ে। নিজ এলাকা টাঙ্গাইলেও দেখা যায়নি কোনো উদ্যোগ। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে দলের অন্যতম নেতা ও গাজীপুরে ঐক্যফ্রন্ট থেকে ভোট করা ইকবাল সিদ্দিকী কোনো সাড়া দেননি।
‘করোনায় মাঠে নেই এমপি সুলতান মনসুর, হতাশ জনগণ’ এমন খবরের শিরোনাম হয়েছেন সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। ভোটের আগে-পরে আলোচিত-সমালোচিত এই নেতা করোনা পরিস্থিতিতে জনগণের পাশে থাকার কথা থাকলেও মৌলভীবাজারের কুলাউড়াবাসী তাকে পাচ্ছেন না। ওই আসনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মনসুরকে কোনো কাজেই পাচ্ছেন না স্থানীয় প্রশাসন। অনেকেই তার নীরবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া করছেন।
জানা যায়, সুলতান মনসুর প্রায় চার মাস থেকে ঢাকার বেইলি রোডের বাসায় অবস্থান করছেন। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর আর তাকে কুলাউড়ায় দেখা যায়নি। ঢাকায় বসে শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার নির্বাচনি এলাকার প্রশাসনসহ জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে এত কিছু বললেও তিনি নিজে এখনও এলাকায় আসছেন না। এমনকি তার ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো ত্রাণ সহায়তা দিতে দেখা যায়নি।
সামাজিক মাধ্যমে এই নেতাদের অনেকে সমালোচনা করে বলছেন, বগুড়ার পরিচিত হিরো আলম যদি একক ক্ষুদ্র চেষ্টায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে, তাহলে তারা নয় কেন? রাজনীতিবিদরা কি শুধুই রাজনীতির মাঠের জন্য, না করোনা প্রতিরোধের যুদ্ধে থাকার জন্যও?