- জিকে প্রকল্প ঘিরে সামাজিক বনায়ন
- মাটির ঘরের বদলে এখন পাকা বাড়িতে বসবাস
ফিরোজ মান্না, কুষ্টিয়া থেকে ফিরে ॥ গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের (জিকে প্রকল্প) দুই পাশে সবুজের বিপুল সমারোহ। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। ফলদ-বনজ ও ঔষধি গাছের ঘন বনের মালা পরে বয়ে চলেছে জিকে প্রকল্প। প্রাকৃতিক নয়, স্থানীয় মানুষের তৈরি এই বনায়ন। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই বনায়ন মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। আগে যে মানুষ মাটির ঘরে বাস করতেন, এখন তিনি নির্মাণ করেছেন পাকা বাড়ি। যাতায়াতের জন্য কিনেছেন মোটরসাইকেল। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে জিকে প্রকল্প ঘিরে মানুষের এই উন্নতি ঘটেছে। সরজমিনে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জিকে প্রকল্প ঘুরে মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতির চিত্র দেখা গেছে।
মিরপুরের চুনিয়াপড়া গ্রামের মোহাম্মদ রবিউল ইসলামের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তার চোখে মুখে উৎসাহ, সাফল্য ও উদ্দীপনার ছাপ। তার সঙ্গে জিকে ক্যানেলের যে দিকেই তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের ছোঁয়ায় প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়া যায়। এই জিকে প্রকল্প যখন গড়ে তোলা হয় তখন তিনি তা দেখেছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, জিকে প্রকল্প হওয়ার পর এলাকায় একটি বড় প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে। সেচের জন্য খাল খননের ফলে অনেক স্থানে গাছপালা কাটা হয়। কিন্তু পরে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জিকে ক্যানেলের দুই পাশেই বৃহৎ আকারে শুরু হয় গাছ লাগানো। এতে যেমন সবুজকে ধরে রাখা গেছে, তেমনি আয়ও করছেন স্থানীয়রা। প্রকল্পের মধ্যেই রয়েছে জিকে ক্যানেল আর তার পাশ ধরে এগিয়ে চলা সবুজে ঘেরা পথ। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে এই এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে স্থানীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে এই কর্মসূচী। ২০০৭ থেকে বনায়নের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম। জিকে ক্যানেলের এক কিলোমিটার ও নিজস্ব পাঁচ বিঘা জায়গায় বনায়ন করেছেন তিনি। ২০০৭ সালে বিনামূল্যে পাওয়া প্রায় সাত হাজার চারা রোপণ করেন তিনি। মাঝে পরিচর্যায় খরচ করতে হয়েছে কিছু অর্থ। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে এসে সেই গাছ বিক্রি করেন ১০ লাখ টাকায়। মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে এক সঙ্গে ১০ লাখ টাকা হাতে পেয়ে বাড়ি করেন এবং নিজে চলাচলের জন্য কেনেন একটি মোটরসাইকেল। এলাকায় রবিউল ইসলামের মতো আরও অনেক কৃষক রয়েছেন যারা বনায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের লাগানো গাছের মধ্যে মেহগনি, ইপিল ইপিল ও রেইনট্রি গাছের সংখ্যা বেশি। এছাড়াও রয়েছে নিমসহ বিভিন্ন প্রকার ফলদ ও ঔষধি গাছ।
রবিউল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এক সময় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না পরিবার। ফলে শিক্ষার হারও কম ছিল। এখন প্রতিটি ঘরে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে। ছেলেমেয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য বড় অংকের টাকার প্রয়োজন হলেই গাছ বিক্রি করে তাদের হাতে টাকা তুলে দিতে পারছেন তারা। বনায়ন-এর এই গাছ বিক্রি করেই তার মেয়েকে বিএ পাস করিয়েছেন। বর্তমানে ছোট ছেলে অনার্সে পড়ছে। নিজে একটি মোটরসাইকেল কিনেছেন এবং পরিবারেও এসেছে সচ্ছলতা। আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো আমি বনায়ন ধরে রাখব। কেননা এই বনায়ন আমার সন্তানদের লেখাপড়া করাতে সাহায্য করেছে এবং পরিবারে দিয়েছে সচ্ছলতা। বনায়ন না থাকলে আমি এত কিছু করতে পারতাম না। আমরা সবাই জানি সামাজিক বনায়ন একটি ভাল কাজ। বনায়নের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আমি এলাকার মানুষদের উৎসাহিত করি। কেননা এতে ব্যক্তিগতভাবে যেমন লাভবান হওয়া যায় তেমনি পরিবেশও ভাল থাকে। পরিবেশ রক্ষায় এই বনায়নের গুরুত্ব অনেক। তার মতে, বনায়ন প্রকল্পে প্রথম পাঁচ থেকে ছয় বছরে তেমন কিছু না এলেও যখন থেকে উপার্জন শুরু হয় তখন একটি বড় অংকের অর্থ পাওয়া যায়। যেটি দিয়ে খুব সহজে পরিবারের জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়।
একই গ্রামে কথা হলো ৬৫ বছর বয়সী ইব্রাহিম হোসেনের সঙ্গে। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচী বনায়নের সঙ্গে যুক্ত। জিকে ক্যানেলের এক কিলোমিটার ও নিজস্ব দুই বিঘা জায়গায় তিনি বনায়ন করেছেন। ৩৬ বছর তিনি এই বনায়নের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার চারা রোপণ করেছেন। গাছ পরিচর্যায় খরচ হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। আর ৭ থেকে ১০ বছর পর সেই গাছ বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লাভ করা সম্ভব। কৃষক ইব্রাহিম হোসেনের লাগানো গাছের মধ্যে মেহগনি গাছের পরিমাণ বেশি। তারপর নিম, বিভিন্ন ফলদ ও ঔষধি গাছ রয়েছে। বর্তমানে ইব্রাহিম হোসেন বনায়নের গাছ বিক্রি করে প্রতিবছর প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা উপার্জন করছেন। যা দিয়ে তিনি কিনেছেন সাত বিঘা জমি। তৈরি করেছেন নতুন বাড়ি। এখন তিনি এলাকায় ধনী লোকজনদের একজন। তিনি বলেন, এই গাছ আমার কাছে ‘লাইফ ইন্স্যুরেন্সের’ মতো। যখন টাকার দরকার হয় বা বিপদে পড়ি তখন এই গাছ বিক্রি করে সমস্যার সমাধান করি। অনেক কৃষক আছে যাদের অভাবের সংসার। তাদের ব্যাংকেও থাকে না টাকা। এই অবস্থায় দুই, একটা গাছ বিক্রি করে সাময়িক সমস্যা সমাধান বা অভাব-অনটন দূর করা সম্ভব। ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, বহু বছর ধরে আমি বনায়নের সঙ্গে যুক্ত আছি। বাকি জীবনও থাকতে চাই। কারণ এই গাছ আমার কাছে সন্তান তুল্য।
শুধু রবিউল ইসলাম বা ইব্রাহিম হোসেন নন, এই এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাচ্ছেন বনায়নের সুফল। গাছের লাকড়ি থেকেও আয় করছেন, মেটাচ্ছেন জ্বালানির প্রয়োজন। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে বনায়ন কর্মসূচীতে আসছেন। তারা এই বনকে ঘিরে নানা স্বপ্ন দেখেন। বনায়নে কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই-আছে লাভের সম্ভাবনা। তাদের হাতে লাগানো চারাগুলো যখন বাড়তে থাকে আকাশের দিকে তখন থেকেই তারা ভবিষ্যতে কি করবে সেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন। সরজমিনে দেখা গাছগুলো কাটার সময় এসেছে। অল্পদিনের মধ্যেই তারা গাছগুলো কাটবেন। হাতে আসবে লাখ লাখ টাকা।