নিউজ ডেস্ক:
দেশে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সংকটের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের জন্য আইসিইউ বা হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার দরকার হয়। এই সংকটের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির খবর হয়ে এসেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উদ্ভাবিত ‘অক্সিজেট’ নামের একটি যন্ত্র।
এই যন্ত্রের মাধ্যমে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদেরও হাসপাতালের সাধারণ বেডে রেখেই উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন–সহায়তা দেওয়া যাবে। যন্ত্রটির উৎপাদন খরচও খুব বেশি নয়। বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ এরই মধ্যে যন্ত্রটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। করোনা চিকিৎসায় যন্ত্রটি ব্যবহারের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন দরকার। সে জন্য যন্ত্রের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দেশের হাসপাতালগুলোর সাধারণ বেডে রোগীকে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। এর বেশি অক্সিজেনের দরকার হলে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা লাগে অথবা আইসিইউতে নিতে হয় কিন্তু বিশেষ ওই ক্যানুলা ও আইসিইউ দুটোরই সংকট থাকায় অনেক রোগীকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হয় না। সম্প্রতি বগুড়ার একটি হাসপাতালে সাতজন রোগীর মৃত্যুর পর স্বজনেরা হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সংকটের অভিযোগ করেছিলেন। এই সংকটের সমাধান দেবে অক্সিজেট। এর মাধ্যমে হাসপাতালের সাধারণ বেডেই প্রতি মিনিটে ৬০ লিটার পর্যন্ত হাই ফ্লো অক্সিজেন দেওয়া যাবে। এই যন্ত্র চলবে বিদ্যুৎ ছাড়াই।
এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই যন্ত্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে। ওই হাসপাতালের আটজন চিকিৎসক যন্ত্রটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের একজন ডা. খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে দেখেছি, প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো। একটি ওয়ার্ডের ৬০ জন রোগীর মধ্যে হয়তো ১৫ জনেরই অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আমাদের হাতে হয়তো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে একটি বা দুটি। এরপরে অক্সিজেন বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই। এর বেশি অক্সিজেন দরকার হলেই রোগীর আইসিইউর প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেটের ব্যবহার বেশ কার্যকর।
চিকিৎসকেরা বলছেন, আইসিইউ ও হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সংকটের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহে অক্সিজেট বেশ কার্যকর।
যেভাবে কাজ করে অক্সিজেট
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, হাসপাতালের সাধারণ বেডে ১৫ লিটারের অক্সিজেন ফ্লো-মিটার থাকে। এটি দিয়েই মাস্কের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়। অক্সিজেট থাকলে একটির জায়গায় দুটি ফ্লো-মিটার ব্যবহার করা যাবে। একটি ১৫, আরেকটি ৫০ লিটারের। অক্সিজেট নিম্নচাপ তৈরি করে পরিবেশ থেকে আরও বাতাস নেয়। দ্বিতীয় সংযোগে ৫০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন থাকে, যাতে প্রয়োজনে মোট ৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। অক্সিজেটে যে মাস্কটি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি একটি নন-ভেন্টেড সিপ্যাপ মাস্ক। এটি খুব দৃঢ়ভাবে মুখে আটকানো থাকে, যেন বাতাস বের না হয়ে যেতে পারে। সবশেষে একটি পিপ ভালভ যুক্ত করে রোগীর জন্য অক্সিজেনের চাপ কত হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এই উদ্ভাবনের নেতৃত্ব দেওয়া বুয়েট শিক্ষক তওফিক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অক্সিজেটকে ১৫ লিটার অক্সিজেন ফ্লো-মিটারের সঙ্গে যুক্ত করলে পরিবেশ থেকে আরও বাতাস যুক্ত করে ৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেনযুক্ত বাতাস তৈরি করতে পারে। হাসপাতালগুলোতে এর ব্যবহার শুরু হলে আইসিইউ সেবার জন্য রোগীর চাপ কমবে।
যেভাবে এল অক্সিজেট
দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর গত বছরের মে-জুনের দিকে অক্সিজেট নিয়ে কাজ শুরু করেন বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়টির জৈবচিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তওফিক হাসান তাঁরই চার ছাত্রকে নিয়ে কাজটি শুরু করেন। ওই চার ছাত্র হলেন মীমনুর রশিদ, ফারহান মুহিব, কায়সার আহমেদ ও কাওসার আহমেদ। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের সহযোগিতা করেন জৈবচিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ তারিক আরাফাত, সহকারী অধ্যাপক জাহিদ ফেরদৌস ও সাঈদুর রহমান।
বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ এরই মধ্যে অক্সিজেট ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
এই উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের জন্য যেসব সিপ্যাপ ডিভাইস আছে, সেগুলোর দাম এক লাখ বা তার থেকে বেশি হয়ে থাকে। হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার দাম ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে অক্সিজেটের পুরো সেট-আপ মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেলে এই খরচ আরও কমে আসবে।
তওফিক হাসান বলেন, নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে অক্সিজেট নিয়ে কাজ শুরু করেন তাঁরা। পরে সরকারের আইসিটি বিভাগের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (আইডিয়া) শীর্ষক প্রকল্প, অঙ্কুর ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ও মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেয়। এই কাজে এখন পর্যন্ত ১৫-২০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য তাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। যন্ত্রটির অনুমোদনের জন্য শিগগিরই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে (ডিজিডিএ) আবেদন করবেন তাঁরা।