১০ জানুয়ারি ১৯৭২ (শরণার্থী জীবনের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরে পথে প্রান্তরে’ থেকে-)
এখন প্রতীক্ষা যাঁর নাম উচ্চারণ করে বাঙালি লড়েছে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ, পাকিস্তানে বন্দি মুক্তিযুদ্ধের সেই মহানায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কবে মুক্ত হন, এসে বিশৃঙ্খল বিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। শোনা যাচ্ছে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার চক্রান্ত করছে প্রতিশোধপরায়ণ পাকিস্তান সর্বাত্মক পরাজয়ের গ্লানি মুছতে।
শুধু মানুষকে ভালোবাসার জন্য গ্রিক পুরাণের শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসকে অমানবিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। সকল কাঁটা ধন্য করে মানুষের জন্য এই ভালোবাসা তাঁর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক কঠিন আত্মশক্তির, মানুষের মধ্যে প্রবাহিত সেই প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কোনো শক্তিই অবনত করতে পারবে না, দেবরাজ জিউসও না। বঙ্গবন্ধু যেন আজ শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস, তাঁর আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পারে নি পাকিস্তান, আমেরিকা-চীনের সমর্থনপুষ্ট হয়েও নয়।
ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খান পর্বের পরিসমাপ্তি হয়েছে, রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেছে আর এক খলনায়ক উচ্চাভিলাষী জুলফিকার আলী ভুট্টো। পশ্চিম পাকিস্তানে দাবি উঠেছে পাকিস্তানের এই গ্লানিকর পরাজয়ের দায় নিয়ে ইয়াহিয়া সহ অন্যান্য জেনারেলদের বিচারের মুখোমুখি করার। সবদিক সামাল দিতে ভুট্টো সামরিক পরাজয়ের কারণ চিহ্নিত করতে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশান গঠন করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাকিস্তানের উপর চাপ আসতে থাকে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ক শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিতে। ইশতেকলাল পার্টির প্রধান প্রাক্তন এয়ারমার্শাল আসগর খান এবং কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ সহ পাকিস্তানের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেন।
ভুট্টো মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি এবং যুদ্ধে হারানো পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমি ফেরত নিয়ে ভারতের সাথে দরকষাকষি করতে চায়। ভারতের সাফ জবাব মুজিবের মুক্তির আগে কোনো কথা নয় পাকিস্তানের সাথে। ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিনমান পাঞ্জাব ও হরিয়ানার সীমান্তবর্তী অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন, যুদ্ধাহত সৈনিকদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং এক সভায় কঠোর ভাষায় বলেছেন ‘আমরা বাঁচব সাহসের সাথে, যুদ্ধ করব সাহসের সাথে এবং প্রয়োজন হলে মরবও সাহসের সাথে’।
১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। দুটি দিন গেল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায়। হঠাৎ বেতারে সংবাদ, তাঁকে মুক্তি দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশেষে নিশ্চিত খবর পাওয়া গেল পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যদায় স্বাগত জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, যদিও তখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি। লন্ডন থেকে দিল্লী। দিল্লী বিমানবন্দরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণকে বাংলাদেশের ও তাঁর নিজের মুক্তির জন্য সহায়তা করায় কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির পর নিজ জনগণের মধ্যে ফিরতে আকুল বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পৌঁছালেন ১০ই জানুয়ারি।
লেখক: অধ্যাপক শেখর কুমার স্যানাল, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ