নিউজ ডেস্ক:
দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের পার্বতীপুর মধ্যপাড়া পাথরখনি টানা তৃতীয়বারের মতো লাভের মুখ দেখছে। ফলে খনির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রোফিট বোনাসও পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর (জিএসবি) ১৯৭৩-১৯৭৫ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া এলাকায় ১২৮ মিটার গভীরতায় কঠিন শিলা আবিষ্কার করে। উত্তর কোরিয়ার মেসার্স কোরিয়া সাউথ কোঅপারেশন করপোরেশনের সাথে পাথরখনি উন্নয়নে ১৯৯৪ সালের মার্চে মূল চুক্তি হয়। কয়েক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর ২০০৭ সালের ২৫ মে পাথরখনির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাথর উত্তোলন কাজ শুরু হয়। প্রতিদিন এক শিফটে পাথর উত্তোলন ছিল ৩০০-৪০০ মেট্রিক টন। বাণিজ্যিকভাবে পাথর উত্তোলন হলেও ছিল না খনির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। একপর্যায়ে খনিটি কয়েকশ’ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বন্ধের উপক্রম হয়। দেশের অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় উন্নত মানের এই শিলাখনিটি।
খনিটিকে সচল রাখতে মধ্যপাড়া পাথরখনির ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং পরিসেবার জন্য জার্মানিয়া স্ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এবং মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) মধ্যে ২০১৩ সালে ২ সেপ্টেম্বর ছয় বছরমেয়াদি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি খনিতে পাথর উৎপাদন শুরু হয়। এ সময় খনিটির বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় ছিল।
নানা বাধা অতিক্রম করে চুক্তির তিন বছর পর জিটিসি তিন শিফট চালু করে প্রতিদিন খনি থেকে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে উৎপাদন ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে। প্রতিদিন তিন শিফটে সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ছয় হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত পাথর উত্তোলন হয়। ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দীর্ঘ লোকসানের কলঙ্ক ঘুচিয়ে প্রথম লাভের মুখ দেখে। ওই অর্থবছরে প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা লাভ হয়। পরের বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২২ কোটি টাকা মুনাফা করে দ্বিতীয়বার লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ধারা অব্যাহত রাখে পাথরখনিটি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও খনিটি লাভজনক হবে। পাথর বিক্রি থেকে ইতোমধ্যে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ কয়েক কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হয়েছে।
বর্তমানে শতাধিক বিদেশী খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশী প্রকৌশলী এবং সাড়ে ৭০০ খনি শ্রমিক বর্তমানে এখানে কাজ করছে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে আদালতের মাধ্যমে জিটিসিকে আরো এক বছর কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয়।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার ভয়াবহতা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই জিটিসি বর্ধিত সময়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১.১ মিলিয়ন টন পাথর উত্তোলন ও আরো দু’টি নতুন স্টোপ নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। চুক্তির বর্ধিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি পাথর উত্তোলনের আশা করছে জিটিসি।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবু দাউদ মুহম্মদ ফরিদুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যে দেশের অন্যান্য খনি প্রকল্পগুলো জনবল অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মধ্যপাড়া পাথরখনির উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাথর উত্তোলন হয়েছে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। এ হিসাবে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি পাথর উৎপাদন হয়েছে। বর্ধিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই আরো দু’টি স্টোপ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। কারণ এই উপজেলারই পার্শ্ববর্তী উৎপাদনে থাকা বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ঠিকাদারি চায়না প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ শ্রমিককে ছুটি দিয়ে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন চালু রেখেছে। ফলে বেকার হয়ে বসে আছে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক।
তিনি জানান, জিটিসি তার কারিগরি দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে খনির উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যয় কোনো প্রকার বৃদ্ধি ছাড়াই বিগত ৭ বছর ধরে খনি পরিচালনা করে যাচ্ছে। একমাত্র জিটিসিই মধ্যপাড়া পাথরখনিতে দৈনিক সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টন পাথর উত্তোলন করে খনিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। জিটিসির এই কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খনিটি সবসময়ই লাভে থাকবে।
হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহবুদ্দীন শাহ বলেন, খনিটিতে প্রতিদিন পাথর বহন ও ক্রেতাদের পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠেছে খনি এলাকা। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকানপাট। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পাথর নেয়ার জন্য খনিতে আসে, সেখানে পাথর লোড-আনলোড করার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন কয়েক শ’ শ্রমিক। এতে করে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে।
এ দিকে পাথর উৎপাদন ও খনি উন্নয়নের পাশাপাশি খনির সামনে ‘জিটিসি চ্যারিটি হোম’ স্থাপন করে খনি শ্রমিকদের উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত সন্তানদের মধ্যে শিক্ষা বৃত্তি, এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং এলাকার আর্থসামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে জিটিসি এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। চ্যারিটি হোমে অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে প্রতিদিন খনি এলাকার ৪০-৫০ জন রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ সেবা দেয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে খনি শ্রমিকদের সন্তানদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি, নন এমপিভুক্ত মধ্যপাড়া মহাবিদ্যালয়কে মাসিক আর্থিক সহায়তা এবং এলাকার মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে। এলাকার মানুষ বলছে, জিটিসির এই সেবামূলক কর্মকাণ্ড দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।