নিউজ ডেস্কঃ
মেক্সিকো সিটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময়ে হারিয়ে যাওয়া এক কবরখানার খোঁজ পান গবেষকেরা। সেখানকার তিনটি কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানাচ্ছেন, কঙ্কালগুলো হয়তো কোনো মহামারিতে মারা পড়া মানুষের। আরও ভালো করে বললে, মহামারি ও দাসব্যবসার শিকার হওয়া তিন আফ্রিকানের। এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি গবেষণা পত্রিকা সায়েন্সম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে।
কবরখানার দেখা মিলেছিল সেই ১৯৮০–এর দশকে। মূলত মেক্সিকো সিটিতে নতুন সাবওয়ে লাইনের খনন চলার সময় কিছু কঙ্কালের দেখা মেলে। তখন বিষয়টি প্রত্নতাত্ত্বিকদের আওতায় চলে যায়। আর তখনই আরও বড় পরিসরে খনন শুরু হয়। ধীরে ধীরে জানা যায় যে, এই কবরখানার স্থানটিতে তারও আগে ছিল এক হাসপাতাল, যা স্থানীয় আদিবাসীদের জন্য আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল।
সে যা–ই হোক সেখানকার মাটির তলা থেকে বের করে আনা কঙ্কালগুলোর মধ্যে তিনটি কঙ্কাল গবেষকেরা আলাদাভাবে পরীক্ষা করেন। ওই তিন কঙ্কালের দাঁতগুলো ছিল পর্তুগাল থেকে দাস হিসেবে আনা আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকানদের মতো। এখন রাসায়নিক পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই আফ্রিকান মানুষেরা ছিলেন আমেরিকায় পা ফেলা প্রথম প্রজন্মের আফ্রিকান। তাঁরাই সম্ভবত ছিলেন আন্তঃমহাদেশীয় দাস ব্যবসার প্রথম দিককার ভুক্তভোগী। একই সঙ্গে তাঁরা সম্ভবত কোনো মহামারিতেই মারা পড়েছিলেন।
১ মে গবেষণা পত্রিকা সায়েন্সম্যাগের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে দাস ও মুক্ত উভয় হিসেবেই মেক্সিকোতে ছিল লাখো আফ্রিকানের বাস। আজকের মেক্সিকানদের মধ্যে সেই ইতিহাসের স্বাক্ষর রয়ে গেছে। প্রতিটি মেক্সিকানের শরীরেই আফ্রিকান বংশানুক্রমিক কিছু চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।
সায়েন্স অব হিউম্যান হিস্টোরি সম্পর্কিত ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের আর্কিওজেনেটিকসের শিক্ষার্থী রদ্রিগো বারকুয়েরা সায়েন্সম্যাগকে বলেন, ‘বাকি নিদর্শনগুলো বিশ্লেষণ করলে এমন আরও অনেক তথ্য মিলতে পারে, যার কথা ইতিহাসে নেই হয়তো।’
ওই তিন কঙ্কালের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে এগুলোর দাঁত থেকে ডিএনএ পৃথক করে তার আইসোটোপ পরীক্ষা করেন গবেষকেরা। এতে দেখা যায়, তিনটিই পুরুষ কঙ্কাল এবং তাদের উৎস পশ্চিম আফ্রিকা। এমনকি তিন কঙ্কালের দাঁতের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে যে খাদ্যাভ্যাস ও জলোহাওয়ার পরিচয় পাওয়া গেছে, তাও পশ্চিম আফ্রিকার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে।
এ সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন সম্প্রতি ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি নিয়ে অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যান স্টোন বলেন, ‘বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যখন একই ফল পাওয়া যায়, তখন তা সত্যিই খুব খুশির ব্যাপার।’
তিনটি কঙ্কালই বর্তমানে মেক্সিকো সিটির ন্যাশনাল স্কুল অব অ্যানথ্রপোলজি অ্যান্ড হিস্টোরির সংরক্ষণাগারে রয়েছে। প্রতিটি কঙ্কালেই সহিংসতা ও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। যে তিন ব্যক্তির কঙ্কাল এগুলো, তারা তাঁদের মধ্য ২০ থেকে মধ্য ৩০–এর মধ্য মারা গেছে। এর মধ্যে একটি কঙ্কাল জানাচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একাধিক গুলি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিল। প্রতিটি কঙ্কালেই ক্ষুধা ও রক্তশূন্যতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। একই সঙ্গে রয়েছে কঠোর শারীরিক শ্রম ও নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার চিহ্ন। আর এই চিহ্নগুলোই বলছে যে, ওই ব্যক্তিরা মুক্ত মানুষ ছিলেন না।
তিন কঙ্কালের মধ্যে দুটিতে থাকা চিহ্ন বলছে, তারা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত ছিল। এর মধ্যে একজনের শরীরে ছিল হেপাটাইটিটস বি এবং অন্যজনের শরীরে অন্য একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সিফিলিস পরিবারভুক্ত। আর এ দুটি অণুজীবই আফ্রিকান ঘরানার। গবেষকেরা বলছেন, হতে পারে আফ্রিকাতে থাকার সময়ই বা দাস হিসেবে জাহাজে করে আনার সময় অন্যদের থেকে তারা সংক্রমিত হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা কীভাবে মারা গিয়েছিল, সে সম্পর্কে গবেষকেরা নিশ্চিত নন।
ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু কঙ্কালগুলো এমন একটি জায়গা থেকে পাওয়া গেছে, যেখানে আগে হাসপাতাল ছিল। ওই হাসপাতাল আবার ছিল আদিবাসীদের জন্য পৃথক করা। আর ওই তিন কঙ্কাল আবার পাওয়া গেছে গণকবর থেকে। তাই গবেষকেরা ধারণা করছেন, তারা কোনো মহামারিতে হয়তো মারা গিয়েছিল। হতে পারে সেই মহামারিহাম বা গুটিবসন্তের কারণে সৃষ্ট। তবে ঠিক কারণটি খুঁজে পাওয়ার মতো কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর অস্তিত্ব গবেষকেরা এখনো পাননি।
সূত্রঃ প্রথম আলো