নিজস্ব প্রতিবেদক:
নাটোর নাটোর জেলার পশ্চিমে অবস্থিত জেলার শেষ প্রান্তের গ্রাম বালিয়াডাঙ্গা। সদর উপজেলার এই গ্রামটির শতভাগ মানুষ ই কৃষির সাথে জড়িত। পূর্ব পুরুষদের হাত ধরে আসা চিরাচরিত নিয়মে চলা কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে এই গ্রামের কৃষকরা আধুনিক কৃষির সংস্পর্শে এসেছে কিছুটা দেরিতে। তবে তাদের নতুন কিছু করার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা সাফল্যর ছোঁয়া পেতে দেরি করেনি।
একসময় গ্রামে সব কৃষকই ধান, পাট , গম চাষ করে থাকলেও বর্তমানে গ্রামটির অন্তত ৪০ জন কৃষক আধুনিক পদ্ধতিতে ‘তাল বেগুন’ চাষ করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মন তাল বেগুন উৎপাদন হয় এই এলাকায়। এই বেগুনকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান আরত। যেখানে সকাল থেকেই গ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত থেকে বেগুন নিয়ে আসেন কৃষকরা। উৎপাদিত এই বেগুন কিনতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে আসেন ব্যাপারীরা।
এ গ্রামের দেখাদেখি আশে-পাশের অন্তত দশটি গ্রামে চাষ শুরু হয়েছে তাল বেগুনের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আরত গুলোতে তাল বেগুনের একেকটি স্তুপ। সেখানে একদিকে কৃষকদের নিয়ে আসা বেগুন পরিমাপ, বাছাই ও বস্তাজাতকরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন আরতের শ্রমিকরা। আবার তাল বেগুনের ক্ষেতে গেলে দেখা যায় একদিকে বেগুন হারভেস্ট করা অন্যদিকে গাছ পরিচর্যা ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যস্ত রয়েছে বেগুন চাষীরা। গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার কৃষক নবীর হোসেন। তিনি প্রতিবেদক’কে জানিয়েছেন তাল বেগুন চাষে তার সাফল্য কথা। তিনি বলেন, তিন ছেলে ও এক মেয়ে সহ ৬ সদস্যর সংসার আমার। বাড়ির পাশের ছোট একটু জমিতে চাষবাস আর ব্যাটারি চালিত অটো চালিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো আমার।
বছর দুইয়েক আগে পরিচিত একজনের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল তাল বেগুনের কথা জানতে পারি। তারপর প্রথমে ১০ কাটা জমিতে শুরু করি এর চাষ। সেই জমিতে ভালো ফলন পেয়ে অটোগাড়িটি বিক্রি করে মনোযোগ দিয়ে তালবেগুন চাষে নেমে পড়ি। তার পরের বছর জমি বর্গা নিয়ে দুই বিঘায় উর্ণিত করি এর চাষ। পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় এখন গ্রামে তাল বেগুন চাষে সফল চাষী হিসাবে পরিচিত হয়েছি। কৃষক নবীর হোসেন বলেন, ‘ বেগুনের চাষে আয়ের টাকা থেকেই কয়েক মাস আগে বড় ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছি। দুই ছেলে ও ছোট মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। সর্বোপরি এখন পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে।
তিনি বলেন, আমার দেখাদেখি অনেকে নতুন ভাবে তাল বেগুনের চাষ শুরু করেছে। বিভিন্ন সময় তারা আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসলে তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকি। বেগুনের আরতে কথা হয় কৃষক আমানুল্লাহ সরকারের সাথে। তিনি বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে তাল বেগুনের চাষ করেছি। সপ্তাহে দুই-তিন দিন বেগুন তুলি। আজকে আরতে ৫ মণ বেগুন নিয়ে এসেছি। প্রতি মণ ১৮০০ টাকা দরে বিক্রি করে বিল হয়েছে ৯ হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, এই দামে বেগুন বিক্রি করে আমরা বেশ লাভবান হচ্ছি। তবে যদি বেগুনে ব্যবহৃত কীটনাশকের দাম একটু কম হতো তাহলে আরও বেশি লাভ করতে পারতাম। আরেক বেগুন চাষি লালন হোসেন জানান, অন্যান্য ফসলের চেয়ে এটার বিপণন ব্যবস্থাটা ভালো।
তাই অন্যদের দেখে উৎসাহিত হয়ে প্রথমে ১ বিঘা ও বর্তমানে ২ বিঘা জমিতে তাল বেগুনের চাষ করছি। তিনি বলেন, অন্য সব ফসলের চেয়ে তাল বেগুনে কয়েক গুণ বেশি পরিচর্যা করতে হয়। প্রতিদিন ক্ষেতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। তবে এত কষ্ট হলেও সারাবছর এর দাম থাকায় এবং গ্রাম থেকেই ব্যপারিরা নিয়ে যাওয়ায় ভালো লাভ করতে পারেন তারা। তিনি আরও বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে তাল বেগুন চাষ করেছি। যেখানে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ টাকার বেগুন বিক্রি করেছি। ক্ষেতে এখনো অনেক বেগুন আছে সেগুলো ধীরে ধীরে বিক্রি করবো। তাল বেগুন চাষে কোনো রোগ বালাই বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আপনাদের।
এমন প্রশ্নে এই কৃষক বলেন, তাল বেগুনের গাছে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগবালাইয়ের আক্রমন হয়। যার জন্য প্রতিদিন আমাদের গাছে পরিচর্যা ও সাপ্তাহে ৩-৪ দিন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। বর্তমানে বেগুন গাছে ফুল পড়া, ডাল পচা, বেগুনে ভাইরাস আক্রমণ সহ গাছ মরে যাওয়া সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কেউ পরামর্শ ও সহযোগিতা না করার অভিযোগ করেন এই কৃষক। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে অনেক কৃষকের ভাগ্য খুলেছে এই বেগুন চাষের মাধ্যমে। কিন্তু বেগুন চাষে মৌলিক সমস্যা গুলোর সমাধানের জন্য পরামর্শ বা সহযোগিতা আমরা কৃষি বিভাগের কারও থেকে পাইনা।
রাজশাহী থেকে আরতে তাল বেগুন কিনতে আসা ব্যাপারী হাসান আলী বলেন, নাটোরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রচুর তাল বেগুনের চাষ হয়। এবং এখানকার বেগুন গুলো মানের দিক থেকেও উন্নত যার কারণে ঢাকাতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বেগুন কিনতে আসার আগের দিন ফোনে কৃষককে বেগুনের রেট জানিয়ে দেই। পরের দিন এসে ওজন করে ভালো ভাবে বস্তাজাতকরণ করে ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী সহ বিভিন্ন আরতে পাঠাই। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে সদর উপজেলায় তাল বেগুনের চাষ হয়েছে ১৬ হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদিত তাল বেগুনের পরিমাণ ৪০০ মেট্রিকটন।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার নীলিমা জাহান জানান, তাল বেগুনসহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের বেগুন চাষ হচ্ছে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এতে কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। তিনি বলেন, উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা উপজেলার প্রতিটি এলাকায় কৃষকের সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। তারা সবার দৌড়গড়ায় পৌঁছাতে না পারলেও প্রতিটি ইউনিয়নে পরামর্শ কেন্দ্র রয়েছে সেখানে গিয়েও কৃষকদের পরামর্শ গ্রহনের সুযোগ রয়েছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে এমন জমিতে এ জাতের বেগুন চাষ করা যায়।
বর্ষাকালে সবজির অনেক ঘাটতি থাকে, ফলে এই সময় তাল বেগুন সবজির এই ঘাটতিকে অনেকটাই লাঘব করে। তিনি বলেন, প্রতিটি তাল বেগুনের ওজন ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। নাটোরের স্থানীয় বাজারে এই বেগুনের চাহিদা কম।