নিউজ ডেস্ক:
এতিম-বিপন্ন শিশুদের জন্য ঢাকায় চারটি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের জন্য নতুন একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি চেয়ে গত ৩১ অগাস্ট আবেদন করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল-এফএইচআই ৩৬০।
জন্মের সময় মা হারায় অনেক নবজাতক। মা থাকলেও অসুস্থতার কারণে অনেকে বুকের দুধ পায় না, আবার পেলেও নবজাতকের পুষ্টির জন্য তা পর্যাপ্ত নয়।
এমন শিশুদেরকে মায়ের দুধ যোগাবে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’। এসব মিল্ক ব্যাংকে দুধ দান করবেন মায়েরা। মা-হারা বা মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছে না এমন নবজাতকদের এই ব্যাংক থেকে দুধ দেওয়া হবে। বাচ্চা মারা গেছে এমন মায়েরাও চাইলে ব্যাংকে দুগ্ধ দান করতে পারবেন।
‘স্ট্রেনদেনিং মাল্টিসেক্টরাল নিউট্রেশন প্রজেক্ট’ এর আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক ইউনিট, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইসিএমএইচ) এই মিল্ক ব্যাংক করতে চায় এফএইচআই৩৬০। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোর সঙ্গে তারা প্রাথমিক চুক্তিও সেরে ফেলেছে।
মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দুই বছর আগে একবার মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে আবেদন করেছিল। কিন্তু ধর্মীয় বিতর্কে তা আটকে যায়।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এফএইচআই৩৬০ যে আবেদন করেছে, সে বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে এমএনঅ্যান্ডসিএইচের লাইন ডিরেক্টর এবং এনএনএসের লাইন ডিরেক্টরের কাছে পাঠানো হয়েছে।
দেশে এ্ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যে প্রয়োজন, সে কথা তুলে ধরে খুরশীদ আলম বলেন, “এতে ধর্মীয় বিষয় জড়িত থাকায় সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
“বিষয়টি নিয়ে এর আগেও একবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন ধর্মীয় দিক থেকে বিরোধিতা করা হয়েছিল। এজন্য একটা ওপেন ডিসকাশন দরকার। ইসলামিক ফাউন্ডেশন আছে, ধর্মীয় নেতারা আছেন, সব স্টেকহোল্ডারদের যুক্ত করে এগোতে হবে।”
মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছেন বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নবজাতক এবং শিশু স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো মায়ের বুকের দুধ। শরীরে পুষ্টি যোগানোর পাশাপাশি বুকের দুধ টিকা হিসেবে কাজ করে, সংক্রমণ প্রতিরোধে কাজ করে।
ফিলিপিন্সের একটি হাসপাতালে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক। ছবি: ইউনিসেফের সৌজন্যে
“মা মারা গেছে এমন নবজাতকের জন্য অন্য মায়ের বুকের দুধ দরকার। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রিম্যাচিওর বাচ্চার পুষ্টির জন্য। বুকের দুধ লাগবে কিন্তু মা পর্যাপ্ত দুধ দিতে পারছে না, মায়ের অপারেশন হলো বা একটা রোগ ধরা পড়েছে, এমন ওষুধ খাচ্ছে যে বুকের দুধ দিতে পারছে না – এ ধরনের নবজাতককে বর্তমানে হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অন্য মায়েদের অনুরোধ করে তার বুকের দুধ খাওয়ানো হয়।কিন্তু এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, ধর্মীয়ভাবেও প্রশ্ন থেকে যায়।
“কার বাচ্চাকে কার দুধ খাওয়াচ্ছি, রেকর্ড রাখছি কি না সেটাও প্রশ্ন। এসব কারণেই মিল্ক ব্যাংক তৈরি করা দরকার।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জন্মের পর প্রতি এক হাজারে ১৬ জন নবজাতকের মৃত্যু হয়। জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি হাজারে ২৯টি শিশুর মৃত্যু হয়।
এফএইচআই ৩৬০ এর অ্যাডভাইজার ডা. গাজী মাসুম আহমেদ বলেন, “শিশু মৃত্যুর প্রধান চারটি কারণের একটি হল মায়ের বুকের দুধ নিশ্চিত করতে না পারা। মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করলে যারা মারা যাচ্ছে তাদের অর্ধেককে বাঁচানো সম্ভব।”
তিনি বলেন, জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ নিশ্চিত করতে হয়। যদি কোনো কারণে বাচ্চাকে তার নিজের মায়ের বুকের দুধ দেওয়া যায় না, বিকল্প হিসেবে এখন কৌটার দুধ দেওয়া হচ্ছে। তাতে শিশু নেক্রোটাইজিং এনটেরোকোলাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে।
“এটা হলে শিশুর সারাজীবন রোগবালাই থাকবে। শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে, কোনোদিন পূর্ণ কর্মক্ষম হয়ে উঠবে না। সেটাকে ঠেকানোর জন্য বুকের দুধ নিশ্চিত করতে হয়। মিল্ক ব্যাংক এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে।”
মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের অগ্রগতি জানতে চাইলে গাজী মাসুম আহমেদ বলেন, ফ্রিজ কেনার প্রক্রিয়া শেষ, হাসপাতালগুলোর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। অনুমতি চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
“এর আগে মিল্ক ব্যাংক স্থাপন নিয়ে আলেম সমাজের একটি অংশের আপত্তি ছিল। বিষয়টির নিষ্পত্তি এবং ডিজি হেলথের অনুমোদন পেলেই মিল্ক ব্যাংকের কাজ শুরু হবে। এর আগে নয়।”
বিতর্ক কেন
মা-হারা নবজাতক কিংবা মা থাকলেও বঞ্চিত শিশুদের জন্য মায়ের দুধের ব্যবস্থা করতে ২০১৭ সাল থেকে কাজ শুরু করে ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ)।
২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর তাদের মিল্ক ব্যাংকের কাজ শুরুর কথা ছিল। সেজন্য বিদেশ থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতিও আনা হয়।
কিন্তু সেই পরিকল্পনা শুনেই ‘হালাল-হারামের বিষয়’ জড়িয়ে আছে জানিয়ে এর বিরোধিতায় নামেন ওলামাদের একটি অংশ। মিল্ক ব্যাংক হলে ‘আইনগত ও ধর্মীয় সমস্যা’ তৈরি হবে দাবি করে উকিল নোটিসও পাঠানো হয়।
বিষয়টি নিয়ে আলেমদের পক্ষ থেকেও দুই ধরনের মতামত আসে। এক পক্ষ বলেছেন, এটা করা হলে ধর্মীয় দিক থেকে জটিলতা তৈরি হবে। আলেমদের আরেকপক্ষের মত, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান করা যায়।
এ অবস্থায় হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক সম্পর্কে ধর্মীয় মতামত জানতে চেয়ে ২০১৯ সালের ৩০ অগাস্ট ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠান আইসিএমএইচ প্রস্তাবিত ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের’ সমন্বয়ক ডা. মো. মজিবুর রহমান।
সেখানে বলা হয়, দুধ ভাই-বোনের ধর্মীয় জটিলতা এড়াতে যে নারীর মেয়ে শিশু, ওই নারীর দুধ খাওয়ানো হবে কোনো মেয়ে শিশুকে, আর ছেলে শিশুর মায়ের দুধ খাবে অন্য ছেলে শিশু।
এছাড়া যেসব মা দুধ দান করবেন এবং যেসব নবজাতক দুধ পান করবে তাদের সব ধরনের তথ্য কম্পিউটার ও রেজিস্ট্রার খাতায় লিখে রাখা হবে। দুধ দানকারী মা এবং গ্রহণকারী শিশু প্রত্যেকেই একটি করে কার্ড পাবেন। তাতে জানা যাবে, কোন বাচ্চা কোন মায়ের দুধ পান করেছিল।
কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতামত না পাওয়ায় হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের সে উদ্যোগটি ঝুলে যায়।
এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অবস্থান জানতে চাইলে গবেষণা বিভাগের মুফতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ গত সেপ্টেম্বরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমরা এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। এটা জাতীয় বিষয়, এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় বলা হচ্ছে, এটা হবে এভাবে বৈধতা দেওয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত এটা এভাবেই আছে।”
এফএইচআই৩৬০ ঢাকায় চারটি মিল্ক ব্যাংক করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকেও যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মী বিতর্কের কী সুরাহা হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর পর রেকর্ড কীভাবে হবে তা নিয়ে আলেম সমাজের আপত্তি আছে। তবে এর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানও রয়েছে।
“দুধ ভাই-বোনের সঙ্গে বিয়ে আমাদের ধর্মে অনুমোদন দেয় না। ভবিষ্যতে এই জটিলতা এড়ানোর নিশ্চয়তায় দেবে মিল্ক ব্যাংক। যে নারী দুধ দান করলেন ওই রেকর্ড তার কাছে, যে শিশুকে খাওয়ালেন তার পরিবারের কাছে এবং মিল্ক ব্যাংকে থাকবে।”
আর এফএইচআই ৩৬০ এর অ্যাডভাইজার ডা. গাজী মাসুম আহমেদ বলেন, “যে শিশুটি দুধ খেয়েছে এবং যে মা দুধ দিয়েছেন- তাদের দুটো আলাদা আইডি নম্বর থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইটি শাখার সহায়তায় ডিজি হেলথের ওয়েবসাইটের ড্যাশবোর্ডে একটা পেইজ তৈরির চিন্তা আছে। দুগ্ধদানকারী মা এবং শিশুর সব তথ্য ড্যাশবোর্ডে থাকবে।
“২০ বছর বা ৩০ বছর পর যখন ওই বাচ্চার বিয়ের বয়স হবে, তখন ওই বাচ্চা যদি জানতে চায় কারও বুকের দুধ খেয়েছে কিনা, তখন সে ওই ডেটাবেইজ থেকে তথ্য জানতে পারবে।”