নিজস্ব প্রতিবেদক:
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরই অংশ হিসেবে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হবে। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বছরজুড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমির অবৈধ দখল রোধ করা, দখলমুক্ত অংশের সৌন্দর্যবর্ধন, নদীর উভয় তীরের পরিবেশগত উন্নয়ন সাধন করা, নদীর দখলমুক্ত তীরভূমিতে অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্যবহার করা, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করাসহ জনসাধারণের জন্য নদীর তীরভূমি উন্মুক্ত করা। আর এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং মেয়াদকাল ধরা হয়েছে জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ সাল পর্যন্ত।
আর এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা নদী বন্দরের আওতায় ঢাকার চার পাশের নদীতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। গত ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। এ সময়ে চার হাজার ৫৩৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ১৪৩ একর নদীর তীরভূমির জায়গা উদ্ধার করা হয়। জরিমানা করা হয় ১০ লাখ ১৯ হাজার টাকা এবং নদীর তীরভূমি দখল করে বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার করে নিলামে বিক্রি করা হয় ১০ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ অভিযান শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর। এ বিশেষ অভিযান চলে ২০২০ সালের ২৩ নবেম্বর পর্যন্ত। এ সময়ে দুই হাজার ৫৬৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ৩৮.৭৫ একর নদীর তীরভূমির জায়গা উদ্ধার করা হয়। এ সময় জরিমানা আদায় করা হয় ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। উদ্ধারকৃত মালামাল নিলামে বিক্রি করা হয় চার কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার টাকা, বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয়া হয় ১২ জনকে এবং ৫০০ টন বর্জ্য অপসারণ এবং এক লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়। ঢাকা নদী বন্দরের আওতায় ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ নবেম্বর ২০২০ সাল পর্যন্ত চলমান অভিযানে মোট উচ্ছেদকৃত স্থাপনা সাত হাজার ১০৮টি, মোট উদ্ধারকৃত নদীর তীরভূমির জায়গা ১৮১.৭৫ একর, মোট জরিমানার টাকা আদায় করা হয় ৪১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, মোট নিলামে বিক্রি করা হয় ১৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯২ হাজার টাকার সম্পদ। উচ্ছেদের সময় মামলা করা হয় দুটি এবং বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয়া হয় ১২ জনকে।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের আওতায় ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে ২৬ নবেম্বর ২০২০ সাল পর্যন্ত চলমান উচ্ছেদ অভিযানে মোট উচ্ছেদকৃত স্থাপনার সংখ্যা এক হাজার ৭৮৯টি, মোট উদ্ধারকৃত নদীর তীরভূমির জায়গা ৮৬.৬০ একর, মোট জরিমানা আদায় করা হয় ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা ও নিলামে মোট বিক্রি করা হয় দুই কোটি ৪২ লাখ ৮৮ হাজার ছয় শ’ টাকা। আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদীবন্দর এলাকায় ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত চলমান উচ্ছেদে মোট ৫০টি স্থাপনা উচ্ছেদ, নদীর তীরভূমির উদ্ধারকৃত জায়গার পরিমাণ এক একর এবং জরিমানা করা হয় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই দিনে নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় ৫৬টি স্থাপনা উচ্ছেদ ও নদীর তীরভূমির ০.৬৫ একর জায়গা উদ্ধার করা হয়। সব মিলিয়ে মোট উচ্ছেদকৃত স্থাপনার সংখ্যা নয় হাজার ছয়টি, মোট উদ্ধারকৃত তীরভূমির জায়গার পরিমাণ ২৬৯ একর, মোট জরিমানা করা হয় ৭৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, মোট জব্দকৃত মালামাল নিলামে বিক্রি করা হয় ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ছয় শ’ টাকা, মোট মামলা হয়েছে দুটি ও বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয়া হয় ১২ জনকে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতির বিষয়ে জানা যায়, নদী দখল ও দূষণরোধে ঢাকা শহরের চারদিকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে ১০ হাজার ৪৪২টি পিলার স্থাপন করা হয়েছে। নদীর সীমানার সঠিকতা নিরূপণে যৌথ জরিপকাজ চলমান রয়েছে। নদীর তীরভূমির অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ চলমান রয়েছে। ঢাকা শহরের চারদিকে ১১০ কিমি নৌপথের ২২০ কিমি নদীর তীর রক্ষা বাঁধসহ ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত ভূমিতে ২০ কিমি ওয়াকওয়ে, বনায়ন, সীমানা পিলার ও দুটি ইকোপার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিআইডব্লিউটিএ’র মাধ্যমে ৮৪৮.৫৫ কোটি (প্রস্তাবিত প্রায় ১৮৮৬.১৮ কোটি ) টাকা ব্যয়ে ঢাকা শহরের চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ প্রকল্প বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমির সীমানা পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় পর্যায় ) বাস্তবায়ন কাজ গত জুলাই ২০১৮ থেকে শুরু হয়েছে এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পটিতে নদীর তীরভূমিতে ৫২ কিমি ওয়াকওয়ে, ৪৪.৮০ কিমি তীররক্ষা, এক কিমি কী ওয়াল, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, তিনটি ইকোপার্ক, ১৯টি আরসিসি জেটি আরসিসি স্টেপসহ নির্মাণ, ছয়টি পন্টুন ও ছয়টি এস্কেভেটর সংগ্রহ কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে প্রকল্পটি সংশোধিত হলে প্রকল্পে নদীর উঁচু তীরভূমিতে ৩৩.৮৮ কিমি ওয়াকওয়ে, নদীর তীরভূমিতে কলামের উপর ১৭.৭৫ কিমি ওয়াকওয়ে, ২৪.৬৮৫ কিমি তীররক্ষা, ৮০টি আরসিসি সিঁড়ি, ১০.০৪৩ কিমি কী ওয়াল, ৩৫.৩৫৮ কিমি ওয়াকওয়ে সংলগ্ন ড্রেন, ০.৩৯৫ কিমি হাঁটার সেতু, ২৯১টি বসার বেঞ্চ, ০.৮৫ কিমি সীমানা প্রাচীর, ভারি যানবাহনের জন্য ১৪টি জেটি, ২১ হাজার বর্গমিটার পাকিং ইয়ার্ড, নয় হাজার বর্গমিটারের তিনটি ইকোপার্ক নির্মাণ ও ৩৫.৩৫৮ কিমি বনায়ন করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএ’র জনসংযোগ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বিআইডব্লিউটিএ ঢাকার চারদিকের নদীতে অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত করে আসছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে নয় হাজার ছয়টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং ২৭০ একর জায়গা উদ্ধার করা হয়েছে। এবং জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ৭৪ লাখ টাকা ও জব্দকৃত মালামাল নিলামে বিক্রি করা হয়েছে ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ৬০০ টাকা।
তিনি আরও জানান, বিআইডব্লিউটিএ’র উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং উচ্ছেদকৃত জায়গায় উন্নয়ন কাজ চলছে।
যুগ্ম সচিব ও বিআইডব্লিউটিএ’র সদস্য (অর্থ) মোঃ নুরুল আলম জনকন্ঠকে বলেন, ঢাকার চার পাশের নদীর ২২০ কিমি ইতোমধ্যে উচ্ছেদ হয়েছে। ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত নদীর দু’পাড়ের ৭০ শতাংশ সীমানা পিলার স্থাপন হয়েছে। সীমানা পিলার, ওয়াকওয়ে, জেটি নির্মান ও ইকোপার্ক নির্মান আগামী জুনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ৪০ কিমি জায়গায় প্রায় চার হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে ওয়াকওয়ে নির্মাল করা হলে ২২০ কিমি জায়গা জুড়ে বৃক্ষরোপণ করা হবে। নদীর দু’পাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সবুজায়ন করা হবে।
তিনি আরও জানান, তিনটি ইকোপার্ক ও ব্যবসাবান্ধব জায়গা নৌবাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য ১৪টি জেটি নির্মাণ করা হবে। যার মধ্যে ছয়টির টেন্ডার ও বাস্তবায়ন কাজ চলছে, বাকি ১৪টির টেন্ডার শীঘ্রই করা হবে। বছিলা থেকে ঢাকা উদ্যান পর্যন্ত ৩.৫ কিমি ওয়াওয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী ২০২১ সালের এপ্রিলের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। বাকি ২১ কিমি ওয়াকওয়ের কাজ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হবে। প্রকল্পের সমস্ত কাজ আমরা আশা করছি ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করতে পারব।