#কার্যবিধি প্রণয়নে রাজউক চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন
#এখন রাজউকে ২৩০ জন ইমারত পরিদর্শক আছেন
রাজধানী ঢাকায় গড়ে ওঠা ভবনগুলোর অবকাঠামো নিরূপণ ও নির্মাণাধীন ভবনের কাজ তদারকিতে থার্ড পার্টি নিয়োগ করতে চায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ সংক্রান্ত একটি কার্যবিধি প্রণয়নে রাজউক চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে নয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। এই তদারকি কার্যক্রম ঠিকঠাক করা গেলে ঢাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা, ভবন ধস, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটির এক কার্যপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ রয়েছে। রাজউক সূত্র জানায়, গত ১১ মার্চ নগর উন্নয়ন কমিটির সভা হয়। সভায় নেওয়া বেশকিছু সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে কার্যপত্রে। এর মধ্যে ভবনের সমীক্ষা ও নির্মাণকাজ তদারকিতে থার্ড পার্টি (তৃতীয় পক্ষ) অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি আসে। এজন্য একটি কার্যবিধি প্রণয়ন করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যানকে সভাপতি ও রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা), সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ), আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রতিনিধিকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। শিগগির তারা বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করবেন।
জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজউকে প্রায় ২৩০ জন ইমারত পরিদর্শক আছেন। তারা রাজউকের বিভিন্ন জোনে কর্মরত। কিন্তু প্রতি মাসে যত সংখ্যক বাড়ি বা ভবন নগরে নির্মাণ করা হচ্ছে, তা এত অল্প জনবল দিয়ে পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। ফলে যে যার মতো করে ভবন নির্মাণ করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজউক অনুমোদিত নকশা মানা হয় না। এজন্য আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রম তদারকি করার পরিকল্পনা করছি।’
গত ১১ মার্চ নগর উন্নয়ন কমিটির সভার কার্যপত্রে নগরে সব ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কারিগরি ব্যক্তির সহায়তায় ভবনে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়মিত তদারকি, ব্যত্যয় পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা, রাজউকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ভবনের নকশা প্রস্তুত, পরিদর্শন ও বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কঠোর জবাবদিহির মধ্যে আনা। এছাড়া মহানগরীতে সম্প্রতি বিভিন্ন ভবনে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কারণ উদ্ঘাটনে কী কী ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, সে বিষয়ে রাজউক কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনাসহ একটি প্রতিবেদন আগামী সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
ওই সভায় রাজউকের এক সমীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, ভৌগোলিকভাবে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সম্প্রতি দ্য গ্লোবাল আর্থকোয়াক ডিজাস্টার রিস্ক ইনডেক্স (ইডিআরআই) রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে একটি অন্যতম শহর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট’র আওতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওন ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার সমীক্ষায় নিরূপণ করা হয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়, টাঙ্গাইলের মধুপুরে দিনের বেলা ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৮ লাখ ৬৫ হাজার (৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ) ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবে ২ লাখ ২৯ হাজার। ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনঃনির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া সমীক্ষায় আরও বলা হয়, সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি (১ দশমিক ৯১ শতাংশ) ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবে ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা)।
নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় এমন সমীক্ষার ফলাফল উপস্থাপনের পর নগর বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন।
সভায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে গ্যাস ফায়ার একটি সিরিয়াস ইস্যু। বাসা-বাড়িতে এস-ট্র্যাপ ব্যবহার করা যাবে না, মাস্টার ট্র্যাপ লাগাতে হবে। গ্যাস সেন্সর দিতে হবে। রাজউকের অনুমোদিত নকশা ও বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন হচ্ছে কি না, তা তদারকি করতে হবে।’
ঢাকার ৯০ শতাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় ঘটেছে বলে জানান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে রাজউকের দায় রয়েছে।’
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা বলেন, ‘২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নানা বিপর্যয়ে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজ করা সম্ভব হবে না।’
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) প্রকৌশলী মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘সিদ্দিক বাজারসহ প্রতিটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার রাখার বিষয়ে বাড়ির মালিকদের সচেতন করতে হবে। বেজমেন্টে যে কোনো দাহ্য পদার্থ রাখা বন্ধ করতে হবে।’
সভায় রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান মিঞা বলেন, নগরে রাজউকের কী করা উচিত সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আজকের সভার আয়োজন করা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সে বিষয়ে পরবর্তী সভায় অবহিত করতে হবে। কারণ, রাজউকের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। রাজউক জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। নগরায়ণে শৃঙ্খলা আনতে পরিদর্শক ও অথরাইজ অফিসারদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।