নিউজ ডেস্ক:
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল। ২৫ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে তা চালানো হয়েছিল দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। গণহত্যার নির্মমতার সাক্ষ্য হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অগণিত বধ্যভূমি ও গণকবর।
মুক্তিযুদ্ধকালে কী পরিমাণ গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তার বিস্তৃত কোনো জরিপ হয়নি। পাওয়া যায় না কোনো পরিসংখ্যান।
সাম্প্রতিককালের একটি জরিপে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে গণহত্যার ঘটনা সম্পর্কে আগের ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে। খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মুক্তিযুদ্ধ কোষ-এর দ্বিতীয় খণ্ডে দেশে ৯৫২টি গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন।
জানা গেছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দেশের ৬৪ জেলায় গণহত্যা-গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্র সম্পর্কে জরিপ পরিচালনার কাজ শুরু করেছে খুলনায় স্থাপিত ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। এরই মধ্যে ২৮টি জেলার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ১৭টি জেলায় জরিপকাজ চলছে। গণহত্যা জাদুঘরের পক্ষ থেকে প্রতিটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে ফলক স্থাপন করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে একটি করে নির্ঘণ্ট গ্রন্থ।
এ পর্যন্ত সম্পন্ন ২৮ জেলার জরিপে ১১ হাজার ৩৫৬টি গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন মিলেছে দুই হাজার ৪৯৮টি। এর মধ্যে মিলেছে ৮৪৬টি গণকবর, ৬৫৪টি বধ্যভূমি, ৯৯৮টি নির্যাতনকেন্দ্র। এই স্মৃতিচিহ্নগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে ৪৭টি।
২৮ জেলার প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে প্রতি জেলায় গড়ে ৪০৫টি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই পরিসংখ্যান অনুসারে সারা দেশের ৬৪ জেলায় গণহত্যার ঘটনা ২৫ হাজারটি সংঘটিত হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। আর ২৮ জেলার মধ্যে স্মৃতিচিহ্ন আছে প্রতি জেলায় গড়ে ৮৯টি। এই হিসাবে দেশের ৬৪ জেলায় পাঁচ হাজার ৭০৯টি স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করেছিল গণহত্যা। নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ এক প্রতিবেদনে জানায়, সেই রাতে নিহত হয়েছে ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু ১ এপ্রিলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকা জানিয়েছিল, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী ৯ মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এক ঘৃণ্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। প্রথম রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষার্থীদের জগন্নাথ হলে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী-অতিথিসহ ৭০ জনকে হত্যা করে খেলার মাঠে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। ছাত্রীদের রোকেয়া হলে হত্যা করা হয় ৪৫ জনকে। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকায় ২৯ মার্চ পর্যন্ত ৬০০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
২৫ মার্চ ঘুমন্ত নগরীতে হামলে পড়ে যে নির্মম নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, তা ছড়ানো হয় সারা দেশে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে পাকিস্তানিদের দোসর মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, নেজামে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় সারা দেশেই চলেছে গণহত্যার ঘটনা। খুলনার চুকনগরে একই দিনে ১০ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামের সব পুরুষকে হত্যা করে নারীদের বিধবা করা হয়েছে। এই গ্রামের নাম এখন বিধবাপল্লী হয়ে গেছে। এভাবে সারা দেশেই ঘটেছে নির্মম গণহত্যার ঘটনা।
গণহত্যার ডিজিটাল মানচিত্র
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মমতার সাক্ষী গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতনকেন্দ্র ও স্মৃতিফলক চিহ্নিত করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি জেলার ৮৩৪টি স্মৃতিচিহ্ন চিহ্নিত করে ম্যাপটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন চিহ্নিত করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রকাশের এমন উদ্যোগ বিশ্বে এটাই প্রথম। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ রকম ম্যাপ আছে বলে আমাদের জানা নেই। পর্যায়ক্রমে সারা দেশের ৬৪ জেলার গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন ও তথ্য ডিজিটাল ম্যাপে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।’
গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব ড. চৌধুরী শহীদ কাদের বলেন, ‘একাত্তরে বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এই স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি থাকলেও আমাদেরও দুর্বলতা রয়েছে। আমরা গণহত্যার দলিলপত্র আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার করতে পারিনি। দেশের মানুষও নিজের এলাকার গণহত্যার তথ্য জানে না। সেই দায় মেটাতে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে একাত্তরের গণহত্যার কথা তুলে ধরতে আমরা নিয়ে এসেছি গণহত্যার ডিজিটাল ম্যাপ।’
ড. চৌধুরী শহীদ কাদের জানান, অত্যাধুনিক জিপিএসের (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) সহায়তায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করে নিখুঁতভাবে একাত্তরের স্মৃতিচিহ্নগুলো বিস্তারিত বিবরণসহ তুলে ধরা হয়েছে ইন্টার-অ্যাকটিভ ম্যাপে।
ডিজিটাল ম্যাপে যে ১০ জেলার একাত্তরের স্মৃতিচিহ্ন চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো—খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পাবনা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, যশোর, নড়াইল ও ফরিদপুর। যে ৮৩৪টি জিপিএস স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে গণহত্যা ৪৫৯, বধ্যভূমি ১৭৭, গণকবর ৯১ ও নির্যাতনকেন্দ্র ১০৭টি।
ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ডিজিটাল ম্যাপের ঠিকানা হচ্ছে ওয়েবসাইটে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতন ও স্মৃতিফলক এই পাঁচটি বিভাগ (উইনডো) রয়েছে। ম্যাপে স্পটগুলোকে এমন ইন্ট্যার-অ্যাকটিভভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে কেউ চাইলেই ওয়েবসাইটে গিয়ে চোখের পলকে সেই স্থানে প্রবেশ করে সেখানকার ছবি দেখতে পারবে; ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।
প্রচ্ছদের ম্যাপে গাঢ় লাল রঙের পিন দিয়ে গণহত্যার স্থান, কালো রঙের পিন দিয়ে বধ্যভূমি, লাল রঙের পিন দিয়ে গণকবর, খয়েরি রঙের পিন দিয়ে নির্যাতনকেন্দ্র ও সবুজ রঙের পিন দিয়ে স্মৃতিফলক চিহ্নিত করা হয়েছে।
ম্যাপের যেকোনো পিনে ক্লিক করলে প্রথমেই ওই স্থানের ছবিসহ নাম আসে। নামের ওপর ক্লিক করলে আসে আরো একাধিক ছবি ও পরিচিতি। প্রতিটি লেখা বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় রয়েছে।
মুনতাসীর মামুন আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটালাইজেশনের কথা বলছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটালাইজেশনের কাজটি কেউ করেনি। আমরা কাজটি শুরু করেছি। যে ১০টি জেলার ম্যাপ প্রকাশ করা হয়েছে, তাতেই গণহত্যার বিশালতা ও ভয়াবহতার একটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ওয়েবসাইটে ম্যাপ প্রকাশ করেছি। ম্যাপটি গুগলের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে সারা বিশ্বের মানুষ একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারবে। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা এসব ব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চেয়েছি।’